Advertisement
E-Paper

আজ কাল পরশুর সিরিয়াল

হানিমুনে গিয়েও স্ক্রিপ্ট লিখেছেন চিত্রনাট্যকার। নায়িকাকে ছুটি দিতে হাপিশ তাঁর ডবল রোল। মেগা সিরিয়ালের সাড়ে বত্রিশ ভাজা নেপথ্য কাহিনির স্বাদ দিচ্ছেন বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়হানিমুনে গিয়েও স্ক্রিপ্ট লিখেছেন চিত্রনাট্যকার। নায়িকাকে ছুটি দিতে হাপিশ তাঁর ডবল রোল। মেগা সিরিয়ালের সাড়ে বত্রিশ ভাজা নেপথ্য কাহিনির স্বাদ দিচ্ছেন বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৮
‘জননী’-তে সুপ্রিয়া চৌধুরী

‘জননী’-তে সুপ্রিয়া চৌধুরী

টেক ওয়ান... ঘোড়ায় চড়ার দৃশ্য। শুক্রবার। ঠিকানা মুম্বই। ইউনিটের লোকজন টুল এগিয়ে দিলেন। তাতেই ভর করে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলেন বাঙালি নায়িকা।

সোমবার। সেদিনও আবার একই রকম দৃশ্য। এবারও টুল এগিয়ে দেওয়া হল।

কিন্তু গলা নামিয়ে নায়িকা বললেন, ‘আমার টুল লাগবে না।’

তারপর? পরিচালক থেকে স্পট বয় সবাইকে একদম স্পিকটি-নট করে দিয়ে প্রায় ঝাঁসির রানির মতো স্বচ্ছন্দে উঠে বসলেন তিনি ঘোড়ায়। ক্যামেরা চলতে শুরু করল। কিন্তু প্রশ্নটা ঝুলে রইল ফ্লোরে উপস্থিত সবার মাথায়। মাঝের দু’দিনে হলটা কী?

টেক টু... রাউন্ড ট্রলির মাঝখানে বসে রয়েছেন অভিনেত্রী। নাচ ভাল জানেন না, অথচ চরিত্রটি এক বাঈজির। এক-আধটা নাচের দৃশ্য তো রাখতেই হবে। উপায়?

মুশকিল আসান হলেন এক হেয়ার ড্রেসার। ট্রলির পিছনে দাঁড়িয়ে প্রায় ধ্রুপদী ‘নাচিয়ে’ হয়ে উঠলেন তিনি। ক্যামেরা-ট্যামেরা ভুলে গিয়ে অভিনেত্রী শুধু ফলো করে গেলেন তাঁকে। দর্শক ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না, ‘বাঈজি’ আদৌ নাচ-টাচ জানেন না।

টেক থ্রি... বিয়ের পর হানিমুনে গিয়েছেন জনৈক চিত্রনাট্যকার। দার্জিলিং। সময়টা এপ্রিলের শেষাশেষি। চমৎকার আবহাওয়া।

ও দিকে নিজের বিকল্প হিসেবে যাকে দিয়ে এসেছিলেন, সে ‘ফেল’ করায় সিরিয়ালের ফ্লোরে এই সাইক্লোন, তো এই সুনামি।

অতএব চিত্রানাট্যকারের কাছে ফোনে প্রথমে আবদার, পরে হুমকি। লেখা পাঠাও, অবিলম্বে লেখা পাঠাও। হানিমুনে ল্যাপটপ নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি চিত্রনাট্যকার। কিন্তু লেখা তো পাঠাতেই হবে।

টাইগার হিল বা ম্যাল মাথায় তুলে চিত্রনাট্যকার বসে গেলেন ডায়লগ লিখতে। সেই লেখা কলকাতায় পাঠানো আর এক হুজ্জতি। ঘোরাঘুরি ক্যানসেল করে কোথায় ফ্যাক্স-মেশিন পাওয়া যায়, খুঁজতে বেরোলেন তিনি।

ঘণ্টা দুয়েক হাঁটাহাঁটি করে শেষে এক ওষুধের দোকান থেকে স্ক্রিপ্ট ফ্যাক্স করতে পারলেন কলকাতায়। হোটেলে ফিরে এসে দেখলেন, সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী গম্ভীর মুখে বাক্স গোছাতে লেগেছেন। এখনই ফিরে যাবেন কলকাতায়।

‘কুরুক্ষেত্র’-য় অপরাজিতা আঢ্য

গল্প? না। নির্জলা সত্যি কাহিনি। মেগা সিরিয়ালের নেপথ্যে অনবরত ঘটতে থাকা হাজার হাজার ঘটনার কয়েক ঝলক মাত্র।

মুম্বইয়ের জুহু বিচে যে ঘোড়াগুলো ভাড়ায় দেওয়া হয় তার একটায় শু্যটের মাঝে সকাল-বিকেলের অনেকগুলো ঘণ্টা কাটিয়ে দু’দিনের মধ্যেই এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছিলেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু ‘চন্দ্রকান্ত’ সিরিয়ালের জন্য খামোকা অত ধকল নিতে গিয়েছিলেন কেন? রূপার কথায়, “আমার দায়বদ্ধতা আমাকে বলছিল যে এই অভিনয়টা করতে হলে নিজের পায়ের জোরেই ঘোড়ায় উঠতে হবে। তাই....।’

ট্রলিতে বসে নিখুঁত ভাবে হেয়ার ড্রেসারকে অনুকরণ করছিলেন যে মেয়েটি, তিনি খেয়ালি দস্তিদার। আর সেই হেয়ার-ড্রেসার ছিলেন শেখর।

তৃতীয় ঘটনাটি চিত্রনাট্যকার সৌরভ সেনগুপ্তর। “অনেক কষ্টে গুম মেরে থাকা বৌকে বোঝাতে হয়েছিল, জীবনের এই অ্যাডভেঞ্চার ন্যাশনাল জিওগ্রাফির ফোটোগ্রাফার আর সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট রাইটারের জীবনেই পাবে।” সরস জবাব সৌরভের।

এ রকম নানান সাড়ে-চুয়াত্তর ঘটতেই থাকে সিরিয়ালের ফ্লোরে।

যেমন জনৈক লাজুক ও মৃদুভাষী পরিচালককে এক অল্পবয়েসি অভিনেত্রী একদিন বলে ফেললেন, “স্যার, আমাকে আপনি মা করে দেবেন না, প্লিজ।”

রূপা গঙ্গোপাধ্যায়

শুনে পরিচালকের মুখ-চোখ লাল। এর পর অভিনেত্রী যা বললেন, তাতে বোঝা গেল, তাঁর অভিনীত চরিত্রের কোলে যেন বাচ্চা-টাচ্চা না আসে। এলে তাঁর কেরিয়ারে ক্ষতি হয়ে যাবে।

প্রতিটি সন্ধ্যায় যা আম-বাঙালির দর্শকের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, বিনোদনের সেই ঢালাও ভিয়েনে শুধু যে মিষ্টি আছে তা নয়, ঝাল-তেতো-টক সব রসেরই ছড়াছড়ি।

অভিনেতা কুশল চক্রবর্তী যেমন স্পষ্ট বলে দিলেন, “অভিনয় ছাড়া আর কিছু তো শিখিনি। তাই প্রতিদিন সকালে অফিস যাওয়ার মতো করে অভিনয় করতে যাই। কিন্তু নিজেকে ছাপিয়ে যেতে হবে, এমন চরিত্র পাই কই?”

কুশল অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনা করার চেষ্টা করেছেন। এক সময় ভেবেছিলেন বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে সিরিয়ালের একটা মেলবন্ধন ঘটাবেন। কিন্তু তাঁর কথায় “এখন শুধু ব্যবসাটাই প্রাধান্য পায়”, তাই অনেক অভিমান নিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন তিনি।

অভিমান তাঁর একার নয়। সিরিয়ালের সঙ্গে সাহিত্যের যোগসূত্র বাংলায় যিনি প্রথম সম্ভব করলেন, সেই সমরেশ মজুমদারও অনেকটা একই কারণে প্রায় দশ বছর আগে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন বাংলা সিরিয়ালের পৃথিবী থেকে। কিন্তু কেন?

‘তেরো পার্বণ’ বা ‘কলকাতা’র মতো জনপ্রিয় সিরিয়ালের রচনাকার সমরেশ মজুমদারের জবাব, “আমার চরিত্রের ওপর কেউ কাঁচি চালাবে এটা মেনে নিতে পারছি না বলেই আজ আর কাজ করতে পারছি না। যখন শুরু করেছিলাম তখন কষ্ট যেমন বেশি ছিল, কমিটমেন্টও। সোনেক্স-এর বসার ঘরে কোনও চেয়ার বা সোফা ছিল না। আমি, জোছনদা (দস্তিদার), সবাই মেঝেয় শতরঞ্চি বিছিয়ে বসেছি, কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু আজ যদি কেউ এসে বলে, আপনার ‘অনিমেষ’ চরিত্রটাকে ছোট করে ‘মাধবীলতা’-কে বড় করে দিন, মেগার সুবিধে হবে, মানতে পারব না ভাই।”

সাহিত্যিকের মন দিয়ে যে পরিবর্তন মানতে পারছেন না সমরেশ মজুমদার, পরিচালকের মাথা দিয়ে তাকেই বিশ্লেষণ করলেন অভিজিৎ দাশগুপ্ত। তাঁর বক্তব্য, “আগেকার সিরিয়াল দেখানো হত সপ্তাহে এক বার, তিন দিন ধরে একটা এপিসোড শু্যট করার মতো সময় থাকত। কিন্তু এখন এক দিনে একটা এপিসোড তুলে ফেলতে হবে। নয়তো টেলিকাস্ট বন্ধ হয়ে যাবে। এই অবস্থায় সূক্ষ্মতা বা শিল্পকে প্রাধান্য দেওয়া সম্ভব? পাড়ার যে কচুরিওয়ালা রোজ শ’-দুই কচুরি ভাজে, তাকে যদি দিনে হাজার কচুরি ভাজতে হয়, কী অবস্থা হবে তার? আর কচুরিগুলোই বা কেমন হবে?” পাল্টা প্রশ্ন রসিক অভিজিতের।

তা’হলে মেগাই যত সমস্যার মূল? মানতে নারাজ বাংলায় মেগা সিরিয়ালের পথিকৃৎ বিষ্ণু পাল চৌধুরী।

অঞ্জনা বসু

বিষ্ণু বললেন, “জননী করার সময় আমি বিখ্যাত সব সাহিত্যিকের কাছে গিয়ে বলেছি, গল্প আপনার, পরিচালনা আমার। শু্যটিঙের প্রয়োজনে অল্প-স্বল্প পরিবর্তন করতে পারি, কিন্তু বড় চেঞ্জ কখনও করব না, এক মাত্র দুলেন্দ্র ভৌমিক ছাড়া কেউ রাজি হননি।”

সাহিত্যিক দুলেন্দ্র ভৌমিক এক বছর ধরে লিখেছিলেন ‘জননী’। এমনও হয়েছে ‘আনন্দলোক’-এর তখনকার সম্পাদক দুলেন্দ্র ভৌমিক সারাদিন অফিস করে রাত এগারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত লিখে দিয়েছেন ‘জননী’র এপিসোড। আর লেখকের প্রতি সম্মানবশত সারারাত উল্টো দিকের চেয়ারে ঠায় জেগে থেকেছেন বিষ্ণু। যাঁর, ‘দেবদাসী’ সিরিয়াল করে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের লাইমলাইটে আসা, সেই বিষ্ণুর দাবি, “চ্যানেল আর প্রোডিউসার ফ্রি-হ্যান্ড দিলে আজও অমন হিট দিতে পারি।”

এই ফ্রি-হ্যান্ডটাই বোধ হয় শিল্পী থেকে লেখক সবার সবচেয়ে কাম্য, কিন্তু টিআরপি-র চক্করে বাঁধা সিরিয়ালের দুনিয়ায় তা যে বড়ই দুর্লভ। চিত্রনাট্যকার প্রীতিকণা পাল রায় যেমন বললেন, “একেকটা সময় একেকটা আইডিয়ার বোলবোলাও চলে এখানে। এখন যেমন চলছে একটা ছেলের দুটো বৌ। মানুষ হিসেবে এগুলো সমর্থন করি না, আর চিত্রনাট্যকার হিসেবে লিখতেও চাই না। কিন্তু লিখতে হয়, কারণ দর্শক বড় বিস্ময়কর বস্তু।”

অভিনেত্রী অপরাজিত আঢ্যর কাছে পাওয়া গেল মুদ্রার অন্য পিঠ। সতেরো বছর ধরে মেগা সিরিয়ালে অভিনয় করা অপরাজিতার কাছে আগেকার পরিস্থিতি এক ভাবে ভাল, এখনকার পরিস্থিতি অন্য ভাবে।

“যে চরিত্রদের দর্শক কানেক্ট করেন, সেই চরিত্রদেরই তাঁরা বার বার দেখতে চান, তাই চ্যানেলও তাঁদের দেখাতে বলে। আর আগে একজন হয়তো লিখতেন, এখন অনেকে মিলে ভাবছেন, লিখছেন। মন্দ কী? সবার রুটি-রুজির ব্যাপার যখন, সবাই মিলে ভাগ করে নেওয়াই তো ভাল,” সাফ জবাব অপরাজিতার।

তা’হলে কি শিল্পের আগে রুটিরুজি? বাংলা সিরিয়ালের জগতে অন্তত সেটাই সত্যি। কুড়ি বছর আগে শুনশান স্টুডিয়ো পাড়ায় কাজ-না-পাওয়া সব টেকনিশিয়ানদের শূন্য দৃষ্টির হাহাকারের চাইতে একদিন-প্রতিদিন চলতে থাকা সিরিয়ালের কর্মব্যস্ততা ঢের ভাল, বলছেন এঁদের অনেকেই।

তার জন্য গল্পের গোরু গাছেও উঠতে পারে? কাহিনির গঙ্গা সাউথ ইন্ডিয়াতেও বইতে পারে। তেমনই একটি গল্প শোনালেন অভিনেত্রী অঞ্জনা বসু।

একটি সিরিয়ালে ডবল্ রোল করছিলেন অঞ্জনা। চরিত্র দুটির একজন সুস্থ, অন্য জন পাগল।

আমেরিকা-প্রবাসী দাদার কাছে ঘুরতে যাবেন বলে এক মাস ছুটি চাই অঞ্জনার। কী ভাবে সম্ভব? খুব সহজ। পাগলিনী চরিত্রটি মেলায় হারিয়ে গেল, সুস্থ জন ঘোষণা করল, নিরুদ্দিষ্টকে খুঁজে না পেলে সে আর বাড়িই ফিরবে না। ব্যস্, কেল্লা ফতে, দুই ‘অঞ্জনা’-কেই সরিয়ে দেওয়া গেল গল্পের ফ্লোর থেকে।

‘তেরো পার্বণ’-এ খেয়ালি দস্তিদার ও সব্যসাচী চক্রবর্তী

এভাবেই হরবখত লাঠি না ভেঙে সাপ মারার খেলা খেলতে খেলতে এগিয়ে চলে সন্ধ্যার মেগা সিরিয়াল।

হাতে গোনা চ্যানেল। কিন্তু অনেক স্লট। অজস্র কুশীলব। সব মিলিয়ে প্রতিদিনই মহাযজ্ঞ। কখনও কখনও তা প্রায় যুদ্ধের চেহারা নেয়। একদিনে দুটো এপিসোড শু্যট করে র্যাঙ্কিং বাড়াতে হবে বলে কাজ চলে সকাল ন’টা থেকে রাত্রি বারোটা। আর তার পর দিন আবারও কল টাইম সেই সকাল আটটাতেই।

কী ভাবে হয়? হওয়াতে হয়।

আর এই হওয়াতে হয় বলেই ছেলেকে হসপিটালে ভর্তি করেও অভিনয় করতে আসেন কেউ, বিয়ের পিঁড়িতে বসেও স্ক্রিপ্ট লেখার আদেশ মানেন চিত্রনাট্যকার। কেউ আবার ইউনিটের স্বার্থে প্রোডিউসার বা চ্যানেলের কথা মেনে ‘ডিরেকটর’ থেকে হয়ে যান ‘ফ্লোর ম্যানেজার’। যান কারণ, ‘দ্য শো মাস্ট গোজ্ অন্’। অবশ্য তার মধ্যেই রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কেউ হয়তো বলে ওঠেন, “প্রয়োজনগুলোকে কমিয়ে আনতে পেরেছি বলেই কম কাজ করতে পারি। আসলে আমি চাই, একটু খিদে থাক।”

খিদের সঙ্গে বাউল গান থাক বা না থাক, মেগা সিরিয়াল থাকবেই। থাকবে ঘরে বাইরে তার রামধনু রং ছড়িয়ে।

বাঙালির ভগবান যে দর্শক।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy