Advertisement
E-Paper

আত্মবিস্মৃত বাঙালিকে ধাক্কা

ব্রাত্য বসুর ‘বোমা’-য়! লিখছেন বিভাস চক্রবর্তী সন ২০১৫। বাংলা মঞ্চে বোমা ফাটালেন ব্রাত্য বসু। তার স্প্লিনটার কোথায় কার গায়ে লাগল, কে আঘাত পেল, কে বেঁচে গেল তার হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি। কিন্তু নাটকের বিষয়বস্তু বা কাহিনির প্রারম্ভ ঠিক একশত দশ বছর পূর্বেকার ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন। আর সেই ইতিহাসের কথা বলতে গেলে আমাদের মাথায় সব চেয়ে আগে যাঁর নামটি এসে পড়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৫ ০০:০৩
নাটকে বিপ্লবীদের সঙ্গে আলোচনায় অরবিন্দ-বেশী দেবশঙ্কর হালদার

নাটকে বিপ্লবীদের সঙ্গে আলোচনায় অরবিন্দ-বেশী দেবশঙ্কর হালদার

সন ২০১৫। বাংলা মঞ্চে বোমা ফাটালেন ব্রাত্য বসু।
তার স্প্লিনটার কোথায় কার গায়ে লাগল, কে আঘাত পেল, কে বেঁচে গেল তার হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি।
কিন্তু নাটকের বিষয়বস্তু বা কাহিনির প্রারম্ভ ঠিক একশত দশ বছর পূর্বেকার ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন। আর সেই ইতিহাসের কথা বলতে গেলে আমাদের মাথায় সব চেয়ে আগে যাঁর নামটি এসে পড়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রায় তিরিশ বৎসর পর ১৯৩৪-এ লেখা নভেলেট ‘চার অধ্যায়’-এর প্রথম প্রকাশ কালে আভাস শিরোনামে যে ভূমিকাটি তিনি লিখেছিলেন সেটি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য।
তার থেকে কয়েকটি মাত্র বাক্য উদ্ধৃত করছি। ‘‘বৈধ আন্দোলনের পন্থায় ফল দেখা দিল না। লর্ড মর্লি বললেন, যা স্থির হয়ে গিয়েছে তাকে অস্থির করা চলবে না। সেই সময় দেশব্যাপী চিত্তমন্থনের যে আবর্ত আলোড়িত হয়ে উঠল তারই মধ্যে একদিন দেখলুম সেই সন্ন্যাসী ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন। স্বয়ং বের করলেন ‘সন্ধ্যা’ কাগজ। তীব্র ভাষায় যে মদির রস ঢালতে লাগলেন তাতে সমস্ত দেশের রক্তে অগ্নিজ্বালা বইয়ে দিলে। এই কাগজেই দেখা গেল বাংলা দেশে আভাসে ইঙ্গিতে বিভীষিকা- পন্থার সূচনা।’’
এই উদ্ধৃতি প্রসঙ্গে দুটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার—এক, সেই সন্ন্যাসী ব্রহ্ম বান্ধব উপাধ্যায় মহাশয় আমার আলোচ্য নয়। দুই, তীব্র সমালোচনার চাপে রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে এই ভূমিকাটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হন। উপন্যাসটিতে অতীন ও এলার সম্পর্কের ওপর বিশাল ছায়াপাত ঘটে গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের অভ্যন্তরীণ টানাপড়েনের—ন্যায়-নীতি বোধ, কর্মকাণ্ড, কর্মপ্রণালী, নেতৃত্বের লড়াই, ব্যাক্তি ও সঙ্ঘের সম্পর্ক ও সংঘাত, এমনকী বিশ্বাসঘাতককে কেন্দ্র করে— যা অন্তু-এলার জীবনে নিয়ে আসে এক চরম ট্র্যাজেডি।

ব্রাত্য বসুর ম্যাগনাম ওপাস ‘বোমা’-তে অতীন-এলা বা ‘ঘরে বাইরে’-র নিখিলেশ-বিমলা-সন্দীপদের কাল্পনিক কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই, এখানে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সময় এবং ইতিহাস, এবং তার বাস্তব কুশীলবরা—অগ্নিযুগের বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ-বারীন ঘোষদের বেঙ্গল রেভোলিউশনারি পার্টির সদস্যরা, তাদের বিপরীতে শাসক ইংরেজের দুর্ধর্ষ দুঁদে প্রশাসক, অত্যাচারী দেশি পুলিশ অফিসার, কিংবা বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইও।

পটভূমি বা চরিত্রগুলি বাস্তব হলেও ব্রাত্য নিজমুখে কিংবা ‘ব্রাত্যজন’ নাট্যদল তাঁদের বিজ্ঞাপনে নাটকটিকে ‘আ ফিকশন’ বলছেন। এটাকে আমি আগাম ‘প্রি এম্পটিভ’ সাবধানতা ছাড়া আর কিছুই বলব না।

উৎপল দত্তের একাধিক নাটক সম্পর্কে, বিশেষ করে ‘কল্লোল’ নিয়ে ইতিহাস বিচ্যুতির যে বিতর্ক দানা বেঁধেছিল আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এই সাবধানী ঘোষণা।

আর উৎপল দত্ত মহাশয়ের নাম যখন উঠলই তখন এই সুযোগে বলে নেওয়া ভাল যে ‘বোমা’ প্রযোজনাটি যে স্কেলে বাঁধা হয়েছে তা স্বতঃই মনে করিয়ে দেয় উৎপলীয় গ্র্যান্ড স্কেল। আত্মবিস্মৃত বাঙালিকে নাড়িয়ে দিতে এই রকমটাই প্রযোজন ছিল হয়তো।

পর্দা ওঠে বোমার কান ফাটানো শব্দ এবং মঞ্চব্যাপী ধোঁয়ার মধ্যে। মঞ্চজোড়া প্রায় বর্গক্ষেত্রকার সামান্য উঁচু একটি পাটাতনের বিভিন্ন প্রান্তে, মাঝখানে, এ ধারে ও ধারে দাঁড়িয়ে একদল বিপ্লবী।

তাঁদের শরীরী ভাষা বলছে তাঁরা অ্যাকশনের জন্য প্রস্তুত, মঞ্চের পেছনে উঠে গিয়েছে প্রায় দুর্গ-সদৃশ একটি কাষ্ঠ-নির্মিত কাঠামো, ডান দিক এবং বাঁ দিক থেকে খাড়াই সিঁড়ি দিয়ে তার মাথায় সোজা ওঠা যায়। আবার সেখান থেকে তার গর্ভে নেমে অদৃশ্য হওয়া যায়, বা দু’পাশ দিয়ে নেমে মঞ্চ থেকে নিষ্ক্রান্তও হওয়া যায়।

উঁচু পর্দার সঙ্গীতের আবহে বিপ্লবীরা লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয়। তাঁদের দেহভঙ্গিমার মধ্যে আছে শক্তি, গতি, এবং ছন্দ।

এই দৃশ্যটাই বেঁধে দেয় গোটা প্রযোজনাটির ভঙ্গি, তার স্কেল এবং ছন্দ। পিনপিনে, মিনমিনে কণ্ঠের মনস্তাত্ত্বিক অভিনয় বা প্রয়োগ এখানে বর্জিত।

ওপরের কাঠামোটির ওপরে আছে একটি ফ্রেমে বাঁধানো সাদা পর্দা। বিভিন্ন সময়ে সেটি ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন কারণে—ঘটনাস্থল বোঝাবার জন্য ডকুমেন্টারির কায়দায় আলোকচিত্র প্রক্ষেপণ এবং তার গায়ে নির্দিষ্ট স্থান কাল উল্লেখ করা। মঞ্চ-চরিত্রের পাশাপাশি তার স্কেচ ভেসে ওঠে পর্দায়। মঞ্চের কোনও অ্যাকশন হঠাৎই মসৃণ ভাবে স্থানান্তরিত হয়ে যায় পর্দার অ্যানিমেশনে— যেমন কিংসফোর্ডের ঘোড়ার গাড়ির ওপর বোমা নিক্ষেপ, বা তাড়া করে নিয়ে জেলের ভেতর নরেন গোঁসাইকে গুলি করে মারা।

ভিন্ন রূপে হলেও উদয়শঙ্করের ‘শঙ্করস্কোপ’-এর কথা মনে পড়ে যায়। মঞ্চ জুড়ে চরিত্রদের চলাফেরা, ছুটোছুটি, বিভিন্ন তলে ওঠা-নামা, কয়েকটি প্রপ/আসবাব বা সেটের খণ্ডাংশমাত্রের পরিমিত ব্যবহার, দ্রুত এবং নিখুঁত শিফটিং প্রতিটি দৃশ্য বা খণ্ডদৃশ্যকে গতিময় করে তোলে।

কখনওই চটকদারি ডিজাইন বা ‘নাট্যভাষা’র নীচে চাপা পড়ে যায় না বিষয় বা চরিত্র। নাট্যশরীরে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে গুঁজে দেওয়া হয় না চিমটি-কাটা রাজনৈতিক বক্তব্য। যা বলা হয় তা স্পষ্ট ভাবেই বলেন নাটককার-নির্দেশক। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমি ব্রাত্যর কাজে খুঁজে পাই ট্র্যাডিশনাল এবং মডার্নের এক শিল্পরসোত্তীর্ণ মিশেল। আবার শুধুমাত্র মঞ্চে যা ঘটে বা বলা হয়, তার বাইরে যাঁরা কিছুই দেখতে বা শুনতে পান না, যে সব ক্ষুদ্রতার পূজারি সমসময়ের কূটকচালিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চান, তাঁরা ব্যক্তি-কেন্দ্রিক বা সময়-কেন্দ্রিক আলোচনা চালিয়ে যেতেই পারেন, তাতে প্রকৃত নাট্যরসিকদের কিছু যায়-আসে না।

আজকাল পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ করি যে অনেক নির্দেশক যতটা মনোযোগী ডিজাইনের ব্যাপারে, অভিনয়ের ক্ষেত্রে ততটা নন। তাই অনেক প্রযোজনা উতরে দেবার চেষ্টা করা হয় বহিরাগত দক্ষ অভিনেতাকে ব্যবহার করে। গ্রুপ থেকে অভিনেতা তৈরি করার সেই পুরাতন পদ্ধতি এখন প্রায়-বর্জিত।

তার কারণ দুটি, নির্দেশক অনেক সময়ই অভিনয়-শিক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন না। দুই, রেডিমেড অভিনেতাকে দিয়ে কাজ চালিয়ে যাবার সহজ পন্থা অবলম্বন করেন অনেকে।

‘ব্রাত্যজন’-এ লক্ষ করলাম অভিনেতা গড়ার ক্ষেত্রে যত্ন নেওয়া হয়। তা না-হলে একটি থেকে আরেকটি নাটকে একজন অভিনেতার ক্রমোন্নতি ঘটত না।

চোখে পড়েছিলেন ‘সিনেমার মতো’তে, দারুণ অভিনয় করলেন ‘কে’-র একটি চরিত্রে, এবার প্রায় শীর্ষ স্পর্শ করলেন ‘বোমা’ প্রযোজনায়— কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজির কথা বলছি। যদিও কিছুটা অতিরেক হয়তো আছে বারীন ঘোষের চরিত্রায়ণে।

পৌলমী বসুও ‘সিনেমার মতো’, ‘কে’, ‘দুটো দিন’-এর (পঞ্চম বৈদিক প্রযোজনা) পথ বেয়ে আজ উৎকর্ষে পৌঁছেছেন।

‘রূদ্ধসঙ্গীত’-এর পর সত্রাজিৎ সরকারকে পুনরাবিষ্কার করলাম একজন পরিপূর্ণ অভিনেতা রূপে। চার্লস টেগার্টের ভূমিকায় দুর্ধর্ষ অভিনয় দেখে মুগ্ধ হলাম।

কৌশিক কর নিজগুণে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা। হেমচন্দ্র কানুনগোর চরিত্রে বুদ্ধিদীপ্তিতে উজ্জ্বল তিনি।

সব অভিনেতার নাম উল্লেখ করা সম্ভব হল না। কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগই ভাল অভিনয় করেছেন।

বোমা-য় টেগার্ট

দেবশঙ্করের অভিনয়ে এ নাটকের শেষাংশে প্রায় ‘এক বক্তার বৈঠক’। এই দুরূহ কাজটি দেবশঙ্কর ছাড়া বোধহয় সম্ভবও হত না। কিন্তু এই অংশটি নিয়েই আমার কিছু বলার থেকে যায়। তার আগে পর্যন্ত যা দেখলাম শুনলাম, তাতেই তো চিত্ত বা মস্তিষ্ক একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারত। নাট্যশরীরের ভারসাম্য এখানে এসে অকারণেই টাল খেল বলে মনে হল। দ্বিতীয়ত এত কিছুর পর আমরা শুনতে প্রস্তুত ছিলাম না ‘ঋষি অরবিন্দ’র নিজস্ব মত, পথ ও কর্মের ন্যায্যতা বা সততা বিষয়ক তাঁর দীর্ঘ প্রতিপাদন। কিংবা দেশ বা দেশবাসী সম্পর্কে তাঁর তিক্তকষায় পর্যবেক্ষণ বা ভবিষ্যদ্বাণী।

নাট্যকারের নিজস্ব ভাবনাচিন্তাই কি এখানে এসে ভিড় করে? কাল্পনিক চরিত্র ‘কল্পনা’ একটি অসাধারণ ভাবনা। কিন্তু শেষটায় তার নাটকীয় উন্মোচনের প্রয়োজন ছিল কি? অভিনেত্রী পৌলমীকে যেন একটু অস্বস্তিতেই ফেলা হল এখানে। এই অংশটির বক্তব্য নাটকের অন্য কোথাও অন্য ভাবে আগেই সেরে নেওয়া যেত হয়তো।

ব্রাত্য এবং ‘ব্রাত্যজন’-এর টেকনিকাল টিম অসাধারণ। সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। আবার এমনটা না হলে ‘বোমা’টাও ফাটানো সম্ভব হত না। আলো ও শব্দের একচ্ছত্র কারিগর দীনেশ পোদ্দারের আলোর ভাবনা, দিশারী চক্রবর্তীর আবহ-ভাবনা, পৃথ্বীশ রাণার মঞ্চভাবনার সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে তার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন অনিন্দ্য নন্দী বা ডি’ময়। রূপসজ্জায় চির-নির্ভরযোগ্য মহম্মদ আলি। অ্যানিমেশন কুশলতায় শৌভিক ভট্টাচার্য। মে মাসের দাবদাহের মধ্যে বৃষ্টিটা এনে যিনি আমাদের মন ভিজিয়ে দিলেন, সেই রেনমেকারটি কে, জানতে ইচ্ছে করে। ১৯৮৮-তে রবীন্দ্রসদন মঞ্চে মস্কো আর্ট থিয়েটারের ‘আঙ্কল ভানিয়া’-তে এমনটা দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম।

স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে সশস্ত্র বিপ্লবীদের সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। তাঁদের কখনও বলা হয়েছে সন্ত্রাসবাদী, কখনও স্বদেশী ডাকাত।

শোনা যায়, এই স্বাধীন ভারতবর্ষের মুজঃফরপুরে শহিদ ক্ষুদিরামের মূর্তির আবরণ উন্মোচনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। কারণ তাঁর বা তাঁদের মতে ক্ষুদিরাম সন্ত্রাসবাদী।

আজও সেই বিতর্ক চলছে— বিভিন্ন সশস্ত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। কিন্তু পরিহাস এই যে, গণতন্ত্রের নামে বা সংবিধানের নামে শপথ গ্রহণ করেও মূলস্রোতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক সংঘর্ষে কত মানুষের যে প্রাণ গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

অন্নদাশঙ্করের ভাষায় প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, তার বেলা?

ছবি: সুব্রত কুমার মন্ডল

bibhas chakraborty boma boma review dramatist bibhas chakraborty bratya basu abp patrika patrika drama review bibhas bratya boma
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy