Advertisement
০৪ মে ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া

র বীন্দ্রনাথের বহুমুখী সৃষ্টির ফসল ছড়িয়ে গিয়েছে দেশে দেশে। কত মানুষের বিচার-বিশ্লেষণের বিষয় হল সে সব সৃষ্টি, সেই সব ভাবনাকে কেন্দ্র করে আপনাপন উদ্‌ভাবনী সৃষ্টির জগতে প্রবিষ্ট হতে চাইল কত জন। যে কোনও বড় স্রষ্টার সমীপে যখন আসি তখন শুধু তাঁর সৃষ্টির দুনিয়ায় আমাদের কৌতূহল সীমাবদ্ধ থাকে না।

কবির আবাস, খণ্ড ১ ও ২, সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য। সিগনেট প্রেস, ২৫০০.০০

কবির আবাস, খণ্ড ১ ও ২, সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য। সিগনেট প্রেস, ২৫০০.০০

অভীককুমার দে
শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৬ ০০:৫১
Share: Save:

র বীন্দ্রনাথের বহুমুখী সৃষ্টির ফসল ছড়িয়ে গিয়েছে দেশে দেশে। কত মানুষের বিচার-বিশ্লেষণের বিষয় হল সে সব সৃষ্টি, সেই সব ভাবনাকে কেন্দ্র করে আপনাপন উদ্‌ভাবনী সৃষ্টির জগতে প্রবিষ্ট হতে চাইল কত জন। যে কোনও বড় স্রষ্টার সমীপে যখন আসি তখন শুধু তাঁর সৃষ্টির দুনিয়ায় আমাদের কৌতূহল সীমাবদ্ধ থাকে না। আমরা তাঁকে নানাখানা করে জানতে চাই, দেখতে চাই। তাঁর জীবন সম্পর্কে আমাদের অসীম আগ্রহ। আমরা তাঁর সব কিছু জানতে চাই, তাঁর রুচি, তাঁর ভাললাগা, তাঁর পোশাক, তাঁর ব্যক্তিগত অভ্যাস সব কিছুতেই আমরা কৌতূহলী।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দেশে দেশে মোর ঘর আছে/ আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া’। প্রায় শেষবেলাকার রচনায় বললেন ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি’। কত দেশে তিনি নিজেও বার বার গেলেন, আশ্রয় নিলেন কত গৃহে। বিশ্বপথিক কবির সারা জীবন কোথায় কোথায় কোন কোন ঘরে ঠাঁই হয়েছিল, শুরু হয়েছে তার বিস্তারিত সন্ধান। রবীন্দ্রজন্মসার্ধশতবর্ষে ভারত সরকারের তৎকালীন সংস্কৃতি সচিব জহর সরকার ভেবেছিলেন, আমাদের দেশে কবি যেখানে যেখানে গিয়েছেন এবং থেকেছেন সেই সব বাড়ির একটা ডকুমেন্টেশন করার কথা। সে ভাবনা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। ২০১১ সালে কবির নীড় এবং স্মৃতির আলোয় কবির আলয় বই দুখানি আমরা পেয়েছি। এ বার এই দুটির থেকে অনেকটা ব্যতিক্রমী ভাবনায় ও চেহারায় দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে সুরঞ্জনা ভট্টাচার্যের কবির আবাস।

‘হেথা নয় হেথা নয়’ এর ডাকে সারা জীবন রবীন্দ্রনাথ চলেছেন। যেখানে যেখানে গিয়েছেন সেখানকার যে সব বাড়িতে থেকেছেন তাদের কথা আলাদা, এই কলকাতা শহর যেখানে তাঁর জন্ম এবং জীবনাবসান সেখানেও নানা সময়ে অন্য নানা বাড়িতে তাঁর রাত কেটেছে। আলিপুরে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের আবহাওয়া অফিসের কোয়ার্টারে, কখনও বা প্রশান্তচন্দ্রের বরাহনগরের অস্থায়ী বাসগৃহে অতিথি হতে কবির অসুবিধা হয়নি। খুবই পছন্দসই হয়েছিল কলকাতা আর্ট কলেজে মুকুলচন্দ্র দে’র ডেরাটি। আর শান্তিনিকেতনের কথা যদি ধরা যায় দেখা যাবে দেখ না দেখ বদলে গিয়েছে কবির ঠিকানা, পুরনো দোতলা কুঠি, দেহলি, উত্তরায়ণ, কোণার্ক, উদীচী, উদয়ন, পুনশ্চ, সুরুল কুঠি, শ্যামলী— নিজেকে বার বার ঠাঁই নাড়া করতে যেন কোনও ক্লান্তি নেই তাঁর বরং সেটাই কাঙ্খিত।

সুরঞ্জনা কবির এ হেন বাসগৃহ পরিক্রমার বিষয়ে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাঁর গ্রন্থ পরিকল্পনায় ও বিন্যাসে প্রভূত পরিশ্রমের ছাপ। তাঁর ছবির সংগ্রহ এই গ্রন্থের সম্পদ হয়ে রইল। গ্রন্থকার সংগ্রহভুক্ত করেছেন অবিভক্ত বাংলায় কবির শ’খানেক আবাস এবং জীবনস্মৃতি-তে কবির স্মরণ করা উত্তর-দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের আবাসগুলি। প্রথম স্থান দখল করেছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, পানিহাটির বাগানবাড়িটাও যে তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। আর যে বাড়িটাকে রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি স্মরণ করেছেন সেটি সাবরমতী তীরে শাহিবাগে অবস্থিত সম্রাট শাহজাহানের প্রাসাদ। সেই প্রাসাদ ছিল সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সরকারি আবাস, সতেরো বছরের তরুণ কবি আমদাবাদে গিয়ে কিছুদিন ছিলেন সেখানে। রবীন্দ্র-সাহিত্যেও এই প্রাসাদ স্থায়ী আসন পেতেছে। শাহিবাগ প্রাসাদের সঙ্গে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের অচ্ছেদ্য যোগ কারও অজানা নয়। সংগৃহীত ছবিগুলি দেখতে দেখতে মনে হয় নিজেদের জোড়াসাঁকোর বাড়ি ছাড়াও কত ভিন্ন ভিন্ন চেহারার বাড়িতে থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ। ইংরেজদের বাংলো কোয়ার্টার, রাজবাড়ি, বাগানবাড়ি, কুঠিবাড়ি, মাটির দেওয়াল খড়ে ছাওয়া বাড়ি আবার বৃক্ষাবাসও আছে এই তালিকায়। আছে তাঁর নৌকা-আবাস ‘পদ্মাবোট’: ‘আমি এখন আর শীঘ্র পদ্মার কোল ছাড়ছি নে। অন্ততঃ বর্ষা পর্য্যন্ত এখানে কাটাব বলে মন স্থির করে নোঙর ফেলে শিকল বেঁধে ঘরকন্না ফেঁদে বসেছি। অতএব... ’।

এই যে সব নানা আকারের আবাসে কবির অবস্থান— কোনওটা প্রাসাদ, কোনওটা বা অট্টালিকা, ভিলা, হাভেলি, একচালা-দোচালা-চারচালার ঘরে ঘরে বয়ে গিয়েছে তাঁর সৃষ্টির স্রোত। কখনও ছোটগল্প রচনায় মেতে আছেন, কখনও স্নানের ঘরে গুনগুন করে গান তৈরি করে চলেছেন। সত্যেন্দ্রনাথের পার্ক স্ট্রিটের বাড়ির তেতলার ঘরে একটা একহারা খাটে বুকে বালিশ নিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে স্লেটের উপর মায়ার খেলা-র গান লিখছেন ও গুনগুন করে সুর দিচ্ছেন। জাপানি শিল্পী কাসাহারার তৈরি বৃক্ষাবাসে রচিত হয় পূরবী-র কিছু কবিতা আর বসন্ত গীতিনাট্যের অনেকগুলি গান। সকাল হতে অল্প বাকি, প্রশান্তচন্দ্র জোড়াসাঁকোয় এসে দেখলেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্যথিত কবি তাঁর নাইটহুড ত্যাগের চিঠি লিখছেন।

ছেলেবেলার স্মৃতি। পেনেটির (পানিহাটি) বাগানবাড়ি।

এ বইয়ের পাতায় পাতায় মুদ্রিত রবীন্দ্র-বাসগৃহের ছবিগুলি দেখতে দেখতে এখানে স্থান পায়নি যে সব ছবি, এ দেশের এবং বিদেশের, তাদের ঘিরে সন্ধানী মন বৃথাই প্রশ্ন করে, উত্তরটাও হয়তো অজানাই থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন গাজিপুরে বসতি করবেন। থাকা হয়নি সেখানে। কিন্তু সেই গঙ্গার তীর যেখানে কবি স্ত্রী, কন্যা সহ বাস করেছিলেন কিছুকাল, সে সব আজ কোথায় অবলুপ্ত। মেজ মেয়ে রেণুকাকে নিয়ে আলমোড়া থেকে কলকাতা ফিরছেন, আলমোড়া থেকে কাঠগোদাম পাহাড়ি পায়ে চলা পথে ত্রিশ-বত্রিশ মাইল। রেণুকাকে স্ট্রেচারে নিয়ে কুলিরা নামছে, কবি হাঁটছেন সঙ্গে সঙ্গে। কাঠগোদামে পৌঁছে জানা গেল সে দিনের গাড়ি ছেড়ে গিয়েছে। স্টেশনের কাছে একটা ধর্মশালায় জায়গা মিলল। একতলায় কাঠের গোলা, দোতলার একটি ঘরে কন্যার বিছানার পাশে সারা রাত পিতা বসে রইলেন। সেই রাতে সেই কাঠের গোলা ছিল সকন্যা আশ্রয় কবির। কোথায় ছিল তার অবস্থান আজ কি কেউ তাকে আর খুঁজে পাবে? আলমোড়ায় যে বাড়িতে সে বার অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, সে বাড়ি আজও আছে। সেখানেই চলছিল শিশু-র কবিতাগুলি রচনার কাজ। বলতে গেলে একটু সুযোগ সুবিধে মতো কবি বেরিয়ে পড়তেন, নিজের দেশের কত প্রদেশের কত গৃহে থেকেছেন। শিলঙের জিত্‌ভূমি-তে থাকার সময় রচিত হল রক্তকরবী, আগের বার সিডলি হাউসে যখন ছিলেন লিখেছিলেন যোগাযোগ। শেষের কবিতা রচনা শুরু হয় কুন্নুরে থাকার সময়ে, শেষ হল বেঙ্গালুরুতে ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের গৃহে।

বিদেশেও কত বাড়িতে রইলেন, কি জানি সে সব বাড়ির খোঁজ কেউ কোনও দিন করবে কি না। লন্ডনে রোদেনস্টাইনের যে বাড়িতে ইয়েটস প্রথম গীতাঞ্জলি-র তর্জমা পাঠ করে শোনালেন। তার মতো বিদেশের কিছু বাড়ির খবর অনেকেই জানেন। কিন্তু সেবারকার সফরে গ্রামে যে কৃষকের বাড়িতে কিছু দিন রবীন্দ্রনাথের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল, সে বাড়ি কি আজও আছে? আমেরিকার আরবানায় যেখানে ছিলেন? জাপানে গিয়ে যে ভারতীয় ব্যবসায়ীর গৃহে অতিথি হলেন— ভাবতে গিয়ে এমন আরও নানা বাড়ির কথা মনে আসে। এমন আরও কত বাড়ির উল্লেখ থাকে তাঁর লেখায় অন্যের লেখায়।

কবির আবাস প্রথম খণ্ড জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, পূর্ববঙ্গের জমিদারি এবং শান্তিনিকেতন নিয়ে, দ্বিতীয় খণ্ডে অবিভক্ত বাংলা ছাড়া বক্রোটা (মুসৌরি), আমদাবাদের শাহিবাগ এবং কর্নাটকের কারোয়ার। প্রতিটি গৃহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ, সেই বাড়িগুলি ঘিরে বিভিন্ন জনের স্মৃতিচারণ, তালিকা রয়েছে সেই সব রচনার, যখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এ বাড়ির বাসিন্দা অথবা সে সব বাড়ির স্মৃতি যখন কবিকে অতীতচারী করেছে।

‘পুরানো আবাস ছেড়ে যাই যবে মনে ভেবে মরি কী জানি কি হবে’, সত্যি কি কিছু ভাবতেন রবীন্দ্রনাথ? পুরাতন আবাস ছেড়ে যেতে দ্বিধা কই? প্রবীণ বয়সে যেন বাড়ি বদলের খেলায় মেতেছিলেন কবি। কবির আবাস বিলাস সূচনা হয়েছিল সম্ভবত জোড়াসাঁকোর লালবাড়ি বা বিচিত্রা ভবন নির্মাণকে কেন্দ্র করে। বাড়ি হলে দেখা গেল সবই ঠিক আছে দোতলা বাড়ির দোতলায় ওঠার সিঁড়িটাই যা নেই। শিলাইদহ থেকে ফিরে শান্তিনিকেতনে প্রথম যে বাড়ি তৈরি করলেন ‘দেহলি’, তার পর ‘নতুন বাড়ি’। ঝড় বৃষ্টির দাপট সহনক্ষম খড়ের চাল নির্মাণের জন্য কবিকে প্রতি বছর বর্ষার আগে প্রস্তুতি নিতে হত। প্রবীণ বয়সে কবির শখের আবাসগুলি সুরেন্দ্রনাথ করের উদ্যোগে ও পরিশ্রমে, নন্দলাল বসুর শিল্প ভাবনার প্রয়োগে নির্মিত হল। শান্তিনিকেতনের গৃহ নির্মাণে অনেক মানুষই স্মরণীয় হয়ে রইলেন।

সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য-র কবির আবাস-চিত্রায়ণ সযত্নে রক্ষা করল অনেকগুলি দুর্লভ ছবি। আশঙ্কা, আরও দিন যেতে যেতে এরও কতক বা বিনষ্ট হয়ে যেত চিরতরে। লেখার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে পাতায় পাতায় বাড়িগুলির বিভিন্ন দিক থেকে দেখা ছবির সমারোহ। এ এক মস্ত প্রাপ্তি। এ যেন নানা স্থাপত্যশৈলীর এক বিচিত্র চিত্রপ্রদর্শনী। শুধু যে ছবি দেখার সুযোগ পাচ্ছি তা তো নয়, সঙ্গে চলেছে ইতিহাসের ধারাবিবরণী। স্থিরচিত্র যেন চলচ্চিত্রের আসন নিয়েছে। ছবিগুলির সিংহভাগ লেখক নিজেই ক্যামেরায় ধরেছেন। কখনও সঙ্গী আলোকচিত্রী সুনীল দাস। যাঁর যোগ নিঃসন্দেহে গ্রন্থটির মর্যাদা বাড়িয়েছে। তবে আলোচ্য গ্রন্থটি প্রকাশের পূর্বে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক বইতে নানা প্রসঙ্গে পূর্বে অপ্রকাশিত ছবি স্থান পেয়েছে, তেমন বেশ কিছু ছবি কবির আবাস গ্রন্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অথচ সূত্রের উল্লেখ কোথাও চোখে পড়ল না।

সুরঞ্জনা এক মস্ত কাজ করেছেন, তাঁর পরিকল্পনাটাই প্রশংসনীয়। এক বড় পটভূমিকা তিনি রচনা করে দিয়েছেন। কাজটি সম্পূর্ণ হয়নি সে কথা স্বীকার করেছেন ভূমিকায়। তাঁর দ্বারা সম্পূর্ণ হবে না জানিয়েছেন সে কথাও, আশা করেছেন ভবিষ্যতে এ কাজ সম্পূর্ণ করতে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেন। এই কাজের মুদ্রণরূপ দেখা হয়নি প্রয়াত গ্রন্থকারের। পাতায় পাতায় রঙিন আলোকচিত্রে মোড়া প্রায় হাজার পাতার গ্রন্থ প্রকাশ আজকের দিনে যে কোনও প্রকাশকের মর্যাদার বিষয়। এমন মূল্যবান গ্রন্থে মুদ্রণপ্রমাদ আশা করা যায় না, বিশেষ করে যখন বছর উল্লেখের ক্ষেত্রে সেটা ঘটে। গ্রন্থটি রবীন্দ্রজীবন সন্ধানে এক অতীব মূল্যবান ও সুখপাঠ্য সংযোজন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE