Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

আদিমতায় নিয়ন্ত্রিত হয় শিল্পীর সৃজন

হ্যারিংটন স্ট্রিট আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত অভিজিৎ গুপ্তের প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষশিল্পী অভিজিৎ গুপ্ত অকাল-প্রয়াত হয়েছেন মাত্র ৬০ বছর বয়সে। যে মেধা, মনন ও প্রতিবাদী চেতনা নিয়ে তিনি কাজ করেছেন সারা জীবন সেই তুলনায় তাঁর খ্যাতি তত বিস্তৃত ছিল না।

শিল্পী: অভিজিৎ গুপ্ত

শিল্পী: অভিজিৎ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

শিল্পী অভিজিৎ গুপ্ত অকাল-প্রয়াত হয়েছেন মাত্র ৬০ বছর বয়সে। যে মেধা, মনন ও প্রতিবাদী চেতনা নিয়ে তিনি কাজ করেছেন সারা জীবন সেই তুলনায় তাঁর খ্যাতি তত বিস্তৃত ছিল না। তাঁর জীবন-দর্শন ও শিল্পদর্শন ছিল যে–কোনও রকম বানিয়ে তোলা খ্যাতি-র বিরোধী। তাঁর প্রকাশের ক্ষেত্র ছিল উত্তর-আধুনিকতা উদ্ভূত বিকল্প রূপকল্প। শিল্পের গতানুগতিক সাধারণ প্রবাহ থেকে তা সব সময়ই একটু স্বতন্ত্র।

২০০৫ সালে গড়ে উঠেছিল ‘খোঁজ কলকাতা’ নামে একটি শিল্পী সংগঠন। শিল্পের সঙ্গে জীবনের ও সমাজের নিবিড় সংযোগ গড়ে তোলা ছিল এর বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্দেশ্য। অভিজিৎ ছিলেন ‘খোঁজ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং অত্যন্ত সক্রিয় কর্মী। ২০০৯ সালে যখন ‘আয়লা’-য় বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের বিস্তৃত অঞ্চল, ধ্বংস হয় অজস্র মানুষের জীবন ও বসতি, তখন ‘খোঁজ’-এর উদ্যোগে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ‘ডিজাইন অব আ ডেল্টা’ নামে। ঝঞ্ঝা ও বন্যা-বিরোধী গৃহ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয় এই প্রকল্পে। অভিজিৎ ছিলেন এর অন্যতম প্রধান রূপকার। তাঁর কাজের ক্ষেত্র ছিল এরকমই জীবন-সম্পৃক্ত। শুধু মাত্র চিত্র-ভাস্কর্য রচনায় তা সীমাবদ্ধ ছিল না। সেই ক্ষেত্রেও অবশ্য তাঁর রূপ-ভাবনা ছিল একান্ত ব্যতিক্রমী।

এই ‘খোঁজ কলকাতা’-র উদ্যোগে এবং হ্যারিংটন স্ট্রিট আর্ট সেন্টারের সহযোগিতায় সেখানে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল অভিজিতের জীবন ও শিল্পকর্ম নিয়ে প্রদর্শনী, যার শিরোনাম ‘আ হেরেটিকস জার্নি’। ‘খোঁজ’-এর অন্যতম প্রধান সংগঠক ও শিল্পী পলা সেনগুপ্ত, ছত্রপতি দত্ত এবং অন্যান্যদের নিবিড় নিষ্ঠায় এটি হয়ে উঠতে পেরেছে দৃষ্টান্তমূলক একটি স্মরণ-প্রদর্শনী।

প্রকৃত অর্থেই একজন ‘হেরেটিক’ বা প্রচলিত পথ ও বিশ্বাসের বিরোধী ছিলেন এই শিল্পী। ১৯৭৫ সালে তিনি আর্ট কলেজের শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে চলে আসেন বিভিন্ন স্থাপত্য পরিকল্পনা ও অভ্যন্তরীণ অলঙ্করণের কাজে। সেখানে যথেষ্ট অভিঘাত সৃষ্টি করে ১৯৯১-তে তিনি ফিরে আসেন সৃজনশীল শিল্পের ক্ষেত্রে।

মার্কসবাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে প্রথম জীবনে তিনি শুরু করেন তাঁর শিল্পচর্চা। ‘দ্য আনঅ্যাভেইলেবল’ শিরোনামে ১৯৮১-র একটি তেলরঙের ক্যানভাসে বিপন্ন জীবনের বাস্তবাশ্রিত একটি ছবি রয়েছে এই পর্যায়ের দৃষ্টান্ত হিসেবে।

১৯৯০-এর দশকে নতুন আলোড়ন এল আমাদের দৃশ্যকলার জগতে। বিশ্বায়ন ও উত্তর-আধুনিকতা — এই দুই পরস্পর বিপ্রতীপ দৃশ্যতার দর্শন আকৃষ্ট করল অধিকাংশ প্রগতিপন্থী শিল্পীকে। তীব্র প্রতিবাদী চেতনার বাহন হয়ে উঠল ‘বিকল্প রূপকল্প’। অভিজিতের কাজেও পরিবর্তন এল এই আদর্শের ভিত্তিতেই। ২০০০ সালে সিমা গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী যার শিরোনাম ছিল ‘অবলিক মেমোয়ার্স অ্যান্ড আদার মাইন্ড গেমস’। তিনি চলে আসেন একেবারে ভিন্নধর্মী আঙ্গিকে। লৌকিক, আদিম ও উপজাতীয় শিল্পের প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ ছিল চিরদিনই। এরকম শিল্পবস্তুর একটি সংগ্রহও তিনি গড়ে তোলেন। এই পর্যায়ে আদিমতা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় তাঁর নিজস্ব সৃজন। কিন্তু আদিমতার এই অনুধ্যান ঠিক আধুনিকতাবাদী শিল্প প্রকল্পের মতো নয়। অনেক রূপান্তরিত। এই প্রদর্শনীতে রয়েছে ‘ফ্ল্যুটিস্ট’ শিরোনামে একটি টেরাকোটা ভাস্কর্য। বিশ্লিষ্ট অবয়বে, প্রায়-বিমূর্ততায় এখানে তিনি মানুষের ক্রন্দনকে মিলিয়েছেন আনন্দের সঙ্গে। ২০০৫ সালে তিনি ব্রাজিলে যান একটি ইউনেসকো ফেলোশিপ নিয়ে। ওখানকার লৌকিক ও আদিমতাকে আত্মস্থ করেন।

এর পর থেকে তাঁর রূপরীতিতে প্রাধান্য পেতে থাকে ভিডিয়ো, ইনস্টলেশন, ফোটোগ্রাফি ও ডিজিটাল আর্ট। কৌতুকে, করুণায় ও শ্লেষে তিনি প্রবহমান জীবনের নানা দিককে, বিশ্বায়ন সঞ্জাত নানা বঞ্চনাকে রূপ দিতে থাকেন তাঁর কাজের মধ্যে। এই লেখার সঙ্গের ছবিটি ২০০১ সালে করা ‘যমপট’ শিরোনামে একটি ছয়-অধ্যায় বিশিষ্ট রচনার একটি অধ্যায়। আত্মপ্রতিকৃতির আলোকচিত্রের সঙ্গে অঙ্কনকে মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এই প্রতিমাকল্প। এর একটি প্রতিমাকল্পে তিনটি রক্তবর্ণ বর্শার ফলা আমূল বিদ্ধ করেছে তাঁর নিজের মুখমণ্ডল। যে ছবিটি দেখছি তাতে অনাবৃত হচ্ছে যেন শিল্পীর নিজেরই সত্তা। উন্মোচিত হচ্ছে নিবিড় তমসা, যে তমসায় আবৃত এই সময়।

উত্তর-আধুনিক পরিস্থিতিতে শিল্পীর প্রয়াস ছিল দেশীয় ঐতিহ্যকে বিশ্বের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE