Advertisement
০৪ মে ২০২৪

দৈত্যের মা

বিজ্ঞাননির্ভর ভয়ের গল্প ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ লেখা হয়েছে দুশো বছর আগে। এখনও তার আবেদন অটুট। গল্পটা যেমন সাড়া-জাগানো, লেখিকার জীবনও কম বর্ণময় নয়। প্র থম সার্থক কল্পবিজ্ঞানকাহিনি কোনটি? বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’। এ কালের এক কল্পবিজ্ঞান লেখকের বর্ণনায়, ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ হল ‘ওরিজিন অব স্পিশিস অব সায়েন্স ফিকশন’।

ড্যানি বয়েল নির্দেশিত ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ নাটকের দৃশ্য

ড্যানি বয়েল নির্দেশিত ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ নাটকের দৃশ্য

পথিক গুহ
শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

প্র থম সার্থক কল্পবিজ্ঞানকাহিনি কোনটি? বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’। এ কালের এক কল্পবিজ্ঞান লেখকের বর্ণনায়, ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ হল ‘ওরিজিন অব স্পিশিস অব সায়েন্স ফিকশন’। অর্থাৎ, বিজ্ঞানাশ্রয়ী কাল্পনিক রচনার সূত্রপাত ওই কাহিনি থেকে। এই ২০১৬ সালে সে উপন্যাসখানি আলোচনার কেন্দ্রে। কারণ, তা লেখা হয়েছিল ১৮১৬ সালে, পাক্কা দুশো বছর আগে। গা-ছমছমে ওই ‘হরর স্টোরি’-র প্রথম নাট্যরূপ ১৮২৩ সালে। নাটকের নাম ‘প্রিজাম্পশন: অর দ্য ফেট অব ফ্র্যাংকেনস্টাইন’। লন্ডনে ইংলিশ অপেরা হাউস-এ প্রথম শোয়ের আগে বিজ্ঞাপন: স্ত্রী সঙ্গে আনবেন না, মেয়ে সঙ্গে আনবেন না, পরিবার সঙ্গে আনবেন না। এমন বিজ্ঞাপনের ঠেলায় হাউসফুল। টিকিটের আকাল। হাড়-হিম করা দৃশ্য দেখে মহিলারা মূর্ছা গেলেন। হলে হুলুস্থুলু। গত দুশো বছরে অন্তত ৯০টি ভার্সন হয়েছে নাটকের। ২০১১ সালে লন্ডনে ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত হয়েছে এমনই এক নাটক। পরিচালক ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’-খ্যাত ড্যানি বয়েল। এ বছর মে মাসে রয়্যাল অপেরা হাউস পেশ করেছে ফ্র্যাংকেনস্টাইন ব্যালে। আর ফিল্ম? ওই গল্প অবলম্বনে আজ পর্যন্ত বানানো ছবির সংখ্যা সত্তরেরও বেশি!

অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার, কাহিনির স্রষ্টা অভিজ্ঞ বয়স্ক কোনও লেখক নন, নেহাতই অষ্টাদশী এক তরুণী। নাম মেরি ওলস্টোনক্রাফ্‌ট শেলি। পরিচয়ে ইংরেজ কবি পারসি বিশে শেলি-র ঘরনি। কিন্তু ওটুকু তথ্যে কিছুই চেনা যাবে না তাঁকে। প্রথম উপন্যাসে চারদিকে সাড়া ফেলে দিলেন যে কবি-পত্নী, তাঁর নিজের ইতিহাসও কম বর্ণময় নয়।

জন্ম ৩০ অগস্ট, ১৭৯৭। বাবা উইলিয়াম গডউইন। মা মেরি ওলস্টোনক্রাফ্‌ট। বাবা লেখক তো বটেই, তবে সাহিত্য-খ্যাতি ছাপিয়ে তাঁর বড় পরিচয় চিন্তাবিদ হিসেবে। ১৭৯৩ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘পলিটিকাল জাস্টিস’ বইতে গডউইন জানিয়ে দেন নিজের মতামত। স্বভাবে তিনি উদার, সমর্থন করেন ফ্রি সেক্স, মনে করেন বিয়ে হল সমাজের অত্যাচার। আর, যে মতামতে তিনি আম ব্রিটিশ নাগরিকের চক্ষুশূল, তা হল, তিনি ঘৃণা করেন রাজতন্ত্র, আর এ হেন মানুষের যা ধর্ম, গডউইনেরও তা-ই। তিনি জোর গলায় প্রচার করেন, ফরাসি বিপ্লব মানবসভ্যতার এক বড় পদক্ষেপ, সুতরাং স্বাগত। ওলস্টোনক্রাফ্‌ট নিজে লেখিকা, কিন্তু তিনিও র‌্যাডিকাল চিন্তার জন্য বিশেষ ভাবে চিহ্নিত। সে চিন্তাকে আজকের যুগে বলা হবে নারীবাদ। ১৭৯২ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ভিনডিকেশন অব দ্য রাইটস অব উওম্যান’ বইখানি নারীস্বাধীনতার পক্ষে জোর সওয়াল। মতাদর্শের কারণে ওলস্টোনক্রাফ্‌ট যে গডউইনের প্রতি আকৃষ্ট হবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

বিয়ে ১৭৯৭-এর ২৯ মার্চ। অর্থাৎ, মেয়ের জন্মের মাত্র পাঁচ মাস আগে। হ্যাঁ, বিয়ের সময় ওলস্টোনক্রাফ্‌ট অন্তঃসত্ত্বা। আর, বিয়ে-প্রথার বিরোধী হয়েও গডউইন তাতে রাজি শুধু ভবিষ্যৎ সন্তানকে সামাজিক ভ্রুকুটি থেকে বাঁচাতে। অবশ্য গডউইনের সঙ্গে প্রেমপর্ব শুরুর আগেই মেরি ‌লিভ-টুগেদার করতেন এক ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে। সেই সম্পর্কের সূত্রে তিন বছরের এক মেয়েও ছিল তাঁর। সেই সন্তান সঙ্গে নিয়েই তিনি আসেন গডউইনের সংসারে।

সরকারি ভাবে বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় দ্বিতীয় কন্যাসন্তান। আর প্রসবকালীন জটিলতা থেকে দশ দিনের মাথায় ওলস্টোনক্রাফ্‌টের মৃত্যু। মেয়ের নাম রাখা হল মায়ের কথা ভেবে। মেরি গডউইন। পড়াশোনায় সে দারুণ! বড় হল মায়ের লেখা পড়ে। বুদ্ধিবৃত্তিতে বাবার অবদান। বিদুষী হিসেবে মেয়েকে গড়ে তোলার লক্ষ্য গডউইনের। সফল হল না স্বপ্ন। গডউইন বিয়ে করলেন আবার। পাত্রী এক প্রতিবেশিনী। এক ছেলে এবং এক মেয়ের মা। এই সৎমা’র বিষনজরে পড়ল গডউইনের প্রথম পক্ষের মেয়ে। তাঁর ভাগ্যে এ বার বাড়ি থেকে দূরের এক হস্টেল। বাবার সঙ্গলাভের একমাত্র পথ দীর্ঘ পত্রালাপ।

স্কুলের ছুটিতে হস্টেল বন্ধ হলে বাড়ি আসা। বাড়িতে সন্ধেবেলা চাঁদের হাট। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ভিড় জমান গডউইনের সঙ্গে আড্ডায়। আসেন কবি স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ। নাট্যকার টমাস হোলক্রফট। লেখক চার্লস ল্যাম্ব। সাহিত্য-সমালোচক উইলিয়াম হ্যাজলিট। আরও অনেকে। আড্ডা গড়ায় অনেক ক্ষণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মজার ব্যাপার, গডউইন এ সব তর্ক থেকে দূরে রাখেন না মেয়েকে। বরং পাশে বসে শুনতে দেন। কারণ, তাঁর ধারণা, ওই শোনা শিক্ষার এক অঙ্গ।

কিন্তু মেরি গডউইনের মন কেড়ে নিলেন বাবার আড্ডাসঙ্গীদের বিশেষ এক জন। শেলি। কাব্যখ্যাতিতে যিনি ইংরেজ পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিচ্ছেন। বয়সে মেরির পাঁচ বছরের বড়। দুই সন্তানের জনক। কবিতা কী হওয়া উচিত, অথবা সমাজকে কী চোখে দেখা উচিত সাহিত্যিকের, এ সব প্রশ্নে এই তরুণ কবির জোরালো বক্তব্য শুনে মেরি অভিভূত। আর শেলি মুগ্ধ মেরির বেশ কিছু লেখা পড়ে। প্রেমে মজলেন ওঁরা। ২৮ জুলাই, ১৮১৪। ষোড়শী মেরিকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন শেলি। রাগে দুঃখে আত্মহত্যা করলেন শেলির স্ত্রী। ক্রুদ্ধ গডউইন। তরুণ কবির আচরণ তাঁর চোখে বিশ্বাসঘাতকতা। ক্রুদ্ধ শেলির বাবাও। বন্ধ করে দিলেন বেকার ছেলেকে অর্থসাহায্য।

আর কপোত-কপোতী? তাদের অবস্থা সঙ্গিন। অর্থাভাবে। দেনা করে সংসার চালানো। ইউরোপে এ শহর থেকে সে শহর। বার বার ঠিকানা বদল শুধু পাওনাদারদের হামলা থেকে বাঁচতে। এর মধ্যে শেলির সিফিলিস। ব্যভিচারের পরিণাম। চিকিৎসা ব্যয়সাধ্য। তা জোগাতে হিমশিম। গোদের ওপর বিষফোড়া— মেরি ঘন ঘন প্রেগন্যান্ট। প্রসবের পর সন্তান বাঁচে না। এ বেদুইন জীবন কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে।

ঠেকল সুইটজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে। যেখানে আস্তানা গেড়েছেন আর এক বিখ্যাত ব্যক্তি। লর্ড বায়রন। তিনি ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে গেছেন ওখানে। এক স্ক্যান্ডালের পরে। স্ত্রী ডিভোর্স করেছেন তাঁকে। এই অভিযোগে যে, বায়রন সম্পর্কে এক বোনের প্রেমাসক্ত। এ দিকে আবার জেনেভা শহরে বায়রনের মিসট্রেস মেরির সৎ-বোন ক্লারা জেন ক্লেয়ারমন্ট। খানিকটা তাঁর ইশারাতেই মেরি এবং শেলির জেনেভা-আগমন। লেমান হ্রদের কাছে এক বাড়ি ভাড়া নেওয়া। আর ওই শহরে বসেই ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ রচনা। লেখার প্রেরণা? এ বার সে গল্প।

প্রেমিকা-সহ শেলি বায়রনের প্রতিবেশী। সাহিত্য-আড্ডায় কাটে দিন। যোগদানকারী চার। বায়রন, তাঁর চিকিৎসক পলিডরি, মেরি এবং শেলি। ১৫ জুন, ১৮১৬। সান্ধ্য আড্ডা জমে উঠেছে। ঘরের বাইরে প্রকৃতি নির্মম। অঝোর ধারায় অবিরাম বৃষ্টি। চলেছে ক’দিন ধরে। এই পরিবেশে কী করা যায়? বিরক্তি কাটাতে এক-এক জন পড়লেন ভূতের গল্প। শিহরন-জাগানো ওই-সব ভূতের গল্প শুনতে শুনতে বায়রন এক সময় বললেন, ‘আসুন, আমরাও সবাই এক-একটা প্রেত-কাহিনি লিখি।’ বায়রন নিজে লিখলেন এক ভ্যাম্পায়ার-কাহিনি। পলিডরি লিখলেন এমন এক মহিলার গল্প, যে কি-হোল দিয়ে তাকাতে গিয়ে বনে যায় অন্ধ। শেলি যা লিখলেন, তা নেহাত মামুলি ভূতের গল্প। আর মেরি?

তাঁর নিজের কথায়, ‘আমি নিজেকে ব্যস্ত রাখলাম একটা গল্প ভাবতে... এমন গল্প, যা উসকে দেবে রোমাঞ্চকর ভয়, যা পড়ে পাঠক শিউরে উঠবে এ-দিক ও-দিক তাকাতে, রক্ত হিম হবে তার, বুক ধড়ফড় করবে। তেমন না-হলে আর ভূতের গল্প কীসে? আমার লাগাতার ভাবনা বিফলে গেল। লেখক-জীবনের যা সবচেয়ে বড় কষ্ট— চেষ্টা করেও বানাতে না-পারা, উদ্বিগ্ন আহ্বানের সাড়া না-মেলা— তা টের পেলাম আমি। রোজ সকালে যে প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম, তা হল, কোনও গল্প মাথায় এল? রোজ এক উত্তর দিতে বাধ্য হলাম: দুঃখজনক না।’

তার পর? মেরি লিখেছেন, রাতের আড্ডায় বায়রন আর শেলি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতেন একটা বিষয়। প্রাণ জিনিসটা আসলে কী? জড় আর সজীব বস্তুতে ফারাক কোথায়? এ-সব রহস্য কি ফাঁস হবে কোনও দিন? আলোচনায় মেরি নির্বাক শ্রোতা। রাত গড়িয়ে প্রায় ভোর। ঘুমোতে যাওয়ার সময়। বালিশে মাথা রাখলেন মেরি। ঘুম এল না। এল কতগুলো ছবি। পর পর দৃশ্যের সিকোয়েন্স। যা তিনি দেখলেন চোখ বুজেও। দেখলেন এক বিজ্ঞানী। যে কাটা হাত-পা, ধড়-মুন্ডু জোড়াতালি দিয়ে বানিয়েছে এক মানুষ। প্রাণসঞ্চার করেছে তাতে। আর ভীষণদর্শন সেই জীব রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়েছে বিজ্ঞানীর দিকে।

মেরির মন্তব্য: ‘চিন্তাটা এত গ্রাস করল আমাকে যে গা-ছমছমে একটা আতঙ্ক খেলে গেল শিরদাঁড়া দিয়ে। মনে হল, বাস্তব জগৎ ছেড়ে চলে যাই সেই কাল্পনিক ভয়ংকর পরিবেশে... সেই ভূত আমাকে নিস্তার দিল না, তাড়া করে বেড়ালো। ভাবতে দিল না অন্য কিছু। বার বার চেষ্টা করেও ফিরলাম ক্লান্তিকর, দুর্ভাগ্যজনক সেই ভূতের গল্পে। ওহ্‌, যদি পারতাম তেমন একটা কাহিনি লিখতে, যাতে আমারই মতো ভয় পেত আমার পাঠক! হঠাৎ আলোর ছটার মতো আনন্দের ঝলকানি খেলে গেল মনে। পেয়ে গেছি! সে রাতে আমার বালিশকে তাড়া করেছে যে প্রেতাত্মা, তার গল্পটা লিখে ফেলতে হবে। আমার মতো ভয় পাবে অন্যরাও। সকালবেলা ঘোষণা করলাম, আমি কাহিনি ভেবে ফেলেছি...’ এই হল উপন্যাসের জন্মবৃত্তান্ত।

প্লট? কলেজে অধ্যাপকদের লেকচার শুনে নায়ক ভিক্টর ফ্র্যাংকেনস্টাইন-এর মন চলে গেল আধুনিক গবেষণায়। বিদ্যুৎ ব্যাপারটা কী? জড় আর জীবের মধ্যে ফারাক কোথায়? ল্যাবরেটরিতে প্রাণ সৃষ্টি করা যায় কী ভাবে? পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলল ছ’বছর। রাতের অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে খণ্ডবিখণ্ড পুরনো লাশ জোগাড় করল ভিক্টর। সে-সব জোড়াতালি দিয়ে তাতে প্রাণসঞ্চার করল সে। কিন্তু দৈত্যাকার সে জীব হল কুৎসিত। তাকে দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিল ভিক্টর। ত্যাগ করল তাকে। যেন কোনও দায়িত্ব নেই নিজের সৃষ্ট জীবের ভালমন্দের।

ক্ষিপ্ত দৈত্য পালাল লোকালয় থেকে। সে থাকতে চায় লোকালয়ে, কিন্তু মানুষ তাকে দেখলে ভয় ও ঘৃণায় শিউরে ওঠে। নিজের করুণ দশার জন্য দৈত্য দায়ী করল তার প্রাণদাতা ভিক্টরকে। প্রতিশোধ নিতে সে গলা টিপে খুন করল ভিক্টরের ছোট ভাইকে। প্রথমে খুনির পরিচয় অজানা থাকলেও, ভিক্টর বুঝতে পারল এ কাজ কার। অনুশোচনা হল তার। আত্মহত্যার কথা ভাবে ভিক্টর। পিছিয়ে যায় শুধু এই ভেবে যে, দৈত্য আরও বড় সর্বনাশ করতে পারে তার পরিবারের, সুতরাং নিজের পরিবারকে বাঁচাতে হবে।

দৈত্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ভিক্টরের। সে কুৎসিত-দর্শন জীব বর্ণনা করে তার দুর্দশা। মানবসমাজের মধ্যে থাকতে চেয়েও সে বার বার প্রত্যাখ্যাত। তার কী অপরাধ? পাপ তো ভিক্টরের, যে তাকে দিয়েছে জীবন। সে চায় সঙ্গ, তা পায় না বলেই হয়েছে হিংস্র। ধ্বংস করতে চায় মানুষকে। জিঘাংসা ত্যাগ করতে পারে দৈত্য, চিরতরে যেতে পারে লোকালয় থেকে দূরে, যদি ভিক্টর তার জন্য বানিয়ে দেয় একটা সঙ্গিনী।

সমস্যা থেকে বাঁচতে সে কাজে নামে ভিক্টর। কিন্তু ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়। সঙ্গিনী পেয়ে বংশবিস্তার করবে দৈত্য। মানবসমাজের সর্বনাশ করবে ওরা দল বেঁধে। সঙ্গিনী না পেয়ে ক্রুদ্ধ দৈত্য নেয় প্রতিশোধ। প্রথমে খুন করে ভিক্টরের বাগ্‌দত্তা এলিজাবেথকে। তার পর ভিক্টরকেও। সিরিয়াল কিলার এ বার হতাশ। স্থির করে, নিজেকেও ধ্বংস করবে সে। গল্পে অবশ্য সে দৈত্য আত্মহত্যা করে না। পালিয়ে যাওয়ার আগে শুধু ঘোষণা করে যায়, ‘আমি মরবই। এখন যে জ্বালা আমায় গ্রাস করছে, তা আর সহ্য করব না। শিকার হব না অতৃপ্তি আর অপ্রাপ্তির।’

গোত্র বিচারে ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ একখানি ‘গথিক নভেল’। মানে, যে জাতের উপন্যাস ১৭৬০ থেকে ১৮২০ সালের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল। ও জাতের কাহিনিতে থাকে রহস্য-রোমাঞ্চ, বিভীষিকা আর অতিপ্রাকৃতের ছড়াছড়ি। সে সব ঘটনা তো ভ্যাম্পায়ার-কেচ্ছায় ভূরি ভূরি। সে জাতের উপন্যাস থেকে ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ আলাদা কীসে? কীসে তার আবেদন ছাপিয়ে যায় রক্তচোষা রাক্ষস-খোক্কসদের অত্যাচার থেকে? সোজা কথায়, মেরি শেলির উপন্যাসের ইউএসপি কী? উত্তর সোজা। ভ্যাম্পায়ার-কাহিনিতে কীর্তিকলাপ যত গা গুলোনোই হোক, সব কিছু নিছক কল্পনাবিলাস। তাতে নেই সমকালীন পরিবেশ থেকে উপাদান সংগ্রহের প্রয়াস। আর ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ হোক যতই কল্পনাশ্রয়ী, মেরি শেলি তাতে মিশিয়েছিলেন পরিবেশ থেকে খুঁজে-আনা উপাদান। পাঠক-মনে বাড়তি সাড়া জাগাতে সে কারণে তিনি সফল।

পরিবেশ-প্রসূত যে উপাদানের কথা বললাম, তা চিনতে সম্প্রতি-প্রকাশিত একখানি বইয়ের কথা বলতে হয়। ‘দি এজ অব ওয়ান্ডার: হাউ দ্য রোমান্টিক জেনারেশন ডিসকভার্ড দ্য বিউটি অ্যান্ড টেরর অব সায়েন্স’। লেখক রিচার্ড হোমস ওই বইতে তুলে ধরেছেন বিশেষ এক যুগ। মূলত অষ্টাদশ শতাব্দী। বিজ্ঞানের এক-একটা আবিষ্কার ঘিরে যখন নতুন নতুন বিস্ময়। সে বিস্ময় সীমাবদ্ধ নয় শুধু ল্যাবরেটরির চার দেওয়ালের মধ্যে। তা সঞ্চারিত জনমানসেও। আর, লক্ষণীয় ব্যাপার, বিজ্ঞানের বিস্ময়ে বিহ্বল কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পীরা। তাঁদের সৃষ্টিকর্মে ঢুকে পড়ছে বিজ্ঞান। উপজীব্য হিসেবে।

বিজ্ঞানের যে আবিষ্কার ঘিরে সে যুগে চার দিকে তোলপাড়, তা হল বিদ্যুৎ। ইতালিতে তা নিয়ে জোর কাজিয়া। এক দিকে পদার্থবিজ্ঞানী আলসান্দ্রো ভোল্টা। অন্য দিকে, চিকিৎসক লুইগি গ্যালভানি। দুজনেই দেখেছেন বিদ্যুৎ প্রয়োগে মরা ব্যাঙের ঠ্যাং কাঁপে। ভোল্টা দাবি করছেন, বিদ্যুৎ কৃত্রিম ব্যাপার, তা সৃষ্টি করা যায়। গ্যালভানি মনে করেন, ইলেকট্রিসিটি জীবদেহের নিজস্ব ব্যাপার, তা লুকিয়ে থাকে জীবকোষে, সুপ্ত অবস্থায় থাকে প্রাণীর মৃত্যু হলেও। তা হলে ইলেকট্রিসিটি কি সেই জিনিস, যা পার্থক্য গড়ে জীবিতে ও মৃতে? মরা মানুষকে কি ফের বাঁচানো যায় কোষের মধ্যে ঘুমিয়ে-থাকা ওই বিদ্যুৎ ফের জাগিয়ে? উত্তর পেতে পরীক্ষা হচ্ছে বিচিত্র। সদ্য-ফাঁসিতে লটকানো মানুষের দেহে দেওয়া হচ্ছে ইলেকট্রিক শক। মজার ব্যাপার, ও রকম পরীক্ষায় মাতছেন না শুধুই কিছু পাগলা বিজ্ঞানী। ও-সব কাজ দস্তুরমত আলোচিত কলেজ-ইউনিভার্সিটির ক্লাসে। মাতামাতির দুই বিষয় বিদ্যুৎ আর প্রাণশক্তিকে উপন্যাসের উপাদান হিসেবে ব্যবহার মেরি শেলির বড় কৃতিত্ব।

কৃতিত্ব শুধু উপাদান সংগ্রহে নয়, অ্যাজেন্ডা উত্থাপনেও। মনে রাখতে হবে, মূল উপন্যাসের নাম শুধু ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন’ নয়, পুরো নাম ‘ফ্র্যাংকেনস্টাইন, অর দি মডার্ন প্রমিথিউস’। নামেই মালুম, মেরি শেলি ফ্র্যাংকেনস্টাইনকে আধুনিক যুগের প্রমিথিউস হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। গ্রিক পুরাণ-কাহিনিতে প্রমিথিউস হল সেই নায়ক, যে মানুষের জন্য স্বর্গলোক থেকে চুরি করেছিল আগুন। ভিক্টরের প্যাশন— বিজ্ঞানচর্চা— তো আগুন নিয়েই খেলা। তার আশীর্বাদ ও অভিশাপ নিয়ে চিন্তিত এক অষ্টাদশী লেখিকার উপহার ওই উপন্যাস। যার অভিঘাত আজও বিদ্যমান। পরমাণু থেকে বিদ্যুৎ না বোমা, জিন মানচিত্র থেকে ওষুধ না আর এক হিটলার বানানো— এ-সব প্রশ্নে যখন বিতর্ক ওঠে, তখন মনে পড়ে দুশো বছর আগে লেখা এক উপন্যাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

frankestein
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE