Advertisement
০৫ মে ২০২৪
ধা রা বা হি ক র হ স্য উ প ন্যা স

স্বাধীনতা তুমি...

স বাই আজকাল সরকারি হাসপাতালের নিন্দে করে, রতনের কিন্তু ভালই লেগেছিল হাসপাতালে থাকার দিনগুলো। খাবারটাই যা একটু খারাপ। দোতলার যে ওয়ার্ডে রতনকে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে ছোঁয়াচে রুগিদের রাখা হয় বলেই বোধহয় নিয়মের একটু কড়াকড়ি।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

সঞ্জয় দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

• (গত সংখ্যার পর) •

স বাই আজকাল সরকারি হাসপাতালের নিন্দে করে, রতনের কিন্তু ভালই লেগেছিল হাসপাতালে থাকার দিনগুলো। খাবারটাই যা একটু খারাপ। দোতলার যে ওয়ার্ডে রতনকে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে ছোঁয়াচে রুগিদের রাখা হয় বলেই বোধহয় নিয়মের একটু কড়াকড়ি। রুগির আত্মীয়রা ওয়ার্ডে ঢুকতে পারত না। মা-বাবা জানলা থেকে হাত নেড়ে যেত। কখনও নার্সরা সদয় হলে তাদের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিত একটা পেয়ারা বা আপেল। সাদা পোশাক পরা নার্সদিদিরা অবশ্য অনেকেই খুব কড়া, মুখরাও। কোনও কারণে রতনকে বোধহয় তাদের ভাল লাগেনি! দু’এক জন ছাড়া সকলেই বেশ কড়া ভাবে কথা বলত তার সঙ্গে। অবশ্য অন্য রোগীদের সঙ্গেও যে খুব ভাল ভাবে কথা বলত তা নয়। ওদের বোধহয় ধরনই ওই রকম।

নার্সরা যেমনই হোক, ডাক্তার দিদিমণির কোনও তুলনা হয় না! রোজ দু’বেলা দেখে যেতেন রতনকে। কোনও কোনও দিন নার্সরা বলত, ‘আজ তো আপনার ডিউটি নেই দিদি। কেন এলেন আবার?’ দিদিমণি বলতেন, ‘সাত নম্বর বেডের পেশেন্টকে একটু দেখে যাই।’ সাত নম্বর বেড মানে রতন। যে দিন ডিউটি থাকত না, সে দিন অনেক ক্ষণ তার পাশে বসে থাকতেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানা প্রশ্ন করতেন। শরীর কেমন, কেমন লাগছে, কী কী খেয়েছে সে— এ সব তো বটেই, তা ছাড়াও একটু একটু করে জেনে নিতেন তাদের বাড়ির অবস্থা, বাবা-মা ছাড়া আর কে কে থাকে বাড়িতে, বোন কত বড়, বিধবা কাকিমা তার কেমন কাকিমা হন, কাকিমার ছেলেমেয়েরা তার বন্ধু কি না, এমন নানা প্রশ্ন। সব উত্তর যে দিতে পারত রতন, তা নয়। এক দিন ডাক্তার দিদিমণি জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘তোমার কাকিমা কবে বিধবা হন? কত দিন আছেন তোমাদের সংসারে?’ বলতে পারেনি রতন। সে তো জন্ম থেকেই কাকিমাকে দেখছে তাদের বাড়িতে।

ডাক্তার দিদিমণিকে এত ভাল লেগে গিয়েছিল রতনের, সে ঠিক করেছিল, অসুখ সেরে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরেও সে মাঝে মাঝে এসে দিদিমণিকে দেখে যাবে। সদর হাসপাতালে আসার রাস্তা তো সে চেনে।

অথচ প্রথম দিন এই ডাক্তার দিদিমণিকে দেখেই কেমন ভয় পেয়েছিল রতন। যে দিন সে ভর্তি হল, সেই রাত্রে ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে এসে তার খাটের পাশে দাঁড়ালেন দিদিমণি। তার চোখের তলা, জিভ, আলজিভ, সব পরীক্ষা করলেন। তার পর তার জামা সরিয়ে বুকে স্টেথোস্কোপ বসাতেই রতন দেখল, দিদিমণির চোখ দুটো কেমন সরু হয়ে গেল! তার মনে পড়ল বেশ কিছু দিন আগের একটা দৃশ্য। জলঙ্গির ঘাটে দাঁড়িয়ে সে হিসি করছে, আর ঠিক ওই রকম চোখে তাকিয়ে আছে কাকিমা!

তত ক্ষণে দিদিমণির কথামত নার্সরা তার খাটের চার দিকে সাদা পরদার দেওয়াল তুলে দিয়েছে। পরদাগুলো কেমন একটা লোহার ফ্রেমের মধ্যে টান টান করে বাঁধা। তলায় চাকা লাগানো। ঘড়ঘড় করে এনে চার দিকে ঘিরে ফেলল তাকে। বেশ মজা লেগেছিল রতনের। এ জিনিস সে আগে দেখেনি!

সাদা পরদার ঘেরাটোপে তাকে ভাল করে দেখলেন দিদিমণি। সঙ্গের নার্সটিকে বললেন ঘরের অন্য রুগিদের খাটের পাশে টানানো ওষুধের চার্টগুলি দেখে আসতে। নার্স বেরিয়ে গেলে সব জামাকাপড় খুলিয়ে ভাল করে তাকে পরীক্ষা করলেন। প্রথমে একটু আপত্তি করেছিল রতন, কিন্তু তার মাথায় হাত রেখে দিদিমণি বললেন, ‘আমি ডাক্তার। আমাদের সব দেখতে হয়, জানতে হয়। না হলে তোমার রোগ সারাব কী করে? তোমার কোনও ভয় নেই, আমি ছাড়া আর কেউ তোমায় দেখবে না।’ ডাক্তার দিদিমণির গলার স্বরে, কথা বলার ভঙ্গিমায় এমন কিছু ছিল যে তাঁকে বিশ্বাস করেছিল রতন। আর লজ্জা করেনি। তার পর থেকেই তাকে রোজ দেখতে আসতেন দিদিমণি।

যে দিন তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল, সে দিনটা স্পষ্ট মনে আছে তার। সকালবেলা তাকে পরিষ্কার করে দিয়েছিল নার্স। নীচে দিদিমণির ঘরে নিয়ে গিয়েছিল। সে দেখে, মা আর বাবা আগে থেকেই এসে বসে আছে। তাকে ঢুকতে দেখেই দিদিমণি চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন।

‘এসো রতন। আজ তোমার শরীর কেমন লাগছে? তুমি কিন্তু ভাল হয়ে গিয়েছ।’ সস্নেহে তার মাথায় হাত রেখেছিলেন দিদিমণি। তার পর বলেছিলেন, ‘তুমি ওই চেয়ারটায় একটু বোসো রতন। আমি তোমার বাবা-মা’কে কয়েকটা জরুরি কথা বলব। তুমি সব কথা বুঝবে না, কিন্তু কথাগুলো তোমাকে নিয়ে, তোমার সামনেই বলব।’

শুধু রতন কেন, তার মনে হয়েছিল মা-বাবাও ডাক্তার দিদিমণির কথা কিছু বুঝতে পারছে না! অনেক ক্ষণ ধরে বাবাকে আর মা’কে বোঝালেন দিদিমণি। মাঝে নার্স এসে দু’বার ডেকে গেল। দিদিমণি গেলেন না। ঘরেই কাগজ নিয়ে আসতে বললেন। চেয়ারে বসেই কাগজ দেখে কী সব ওষুধের কথা বলে দিলেন নার্সকে। তার পর আবার মগ্ন হয়ে গেলেন মা-বাবার সঙ্গে বাক্যালাপে। রতন দেখল, ডাক্তার দিদিমণি যতই মা’কে বোঝাচ্ছেন, ততই শীতের সন্ধ্যার মতো অন্ধকার নেমে আসছে মায়ের মুখে। তবে কি তার অসুখ আর সারবে না? আবার জ্বর আসবে তার? জ্বরের ঘোরে মরেই যাবে বোধহয় সে। বাবার মাথাটাও একটু একটু করে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

‘কী বলছেন দিদি! আমার এমন সর্বনাশ হবে?’ হাউহাউ করে কঁাদছে মা!

তা হলে বোধহয় রতনের আর আশা নেই! কিন্তু দিদিমণি যে তাকে বললেন, তুমি ভাল হয়ে গিয়েছ? সে যদি না-ই সারবে, তা হলে তাকে মিথ্যে কথা কেন বললেন? অভিমানে চোখ ভিজে এল রতনের।

‘সর্বনাশ কেন হবে? আপনি ও ভাবে ভাবছেন কেন? বললাম তো এটা রেয়ার ঘটনা, কিন্তু একেবারে হয় না তা তো নয়। আজকের যুগে ও ভাবে ভাবলে চলে?’

ডাক্তার দিদিমণি টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে মা’র হাত ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

মা’কে এ ভাবে কেঁদে উঠতে কখনও দেখেনি রতন। বাবাকেও কখনও দেখেনি এ ভাবে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকতে।

‘কোনও উপায়ই কি নেই?’

বাবার গলাটা অত ফ্যাঁসফেঁসে শোনাচ্ছে কেন?

‘উপায় থাকবে না কেন? এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের কত উন্নতি হয়েছে। আজকাল এটা অপারেশন করে ঠিক করা যায়। তবে তার জন্য ওকে ঠিকমত পরীক্ষা করা দরকার।’ ডাক্তার দিদিমণি মা’কে ছেড়ে এ বার বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন।

‘এখানে হবে?’ বাবা যেন একটু আশার আলো দেখতে পেয়েছে!

‘এখানে, মানে কৃষ্ণনগরে? নাহ্‌, এখানে কী করে হবে? আপনাদের কলকাতায় যেতে হবে।’

‘সে তো অনেক খরচের ব্যাপার!’

‘হ্যাঁ খরচ... মানে... সরকারি হাসপাতালে এ কাজ হবে কি না জানি না, তবে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারি। না হলে প্রাইভেটে করাতে গেলে...’ এ বার দিদিমণিও একটু ইতস্তত করছেন।

‘আমরা পারব না দিদি, আমরা পারব না! এ কী সর্বনাশ হল আমাদের গো!’ আবারও হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছে মা।

সে দিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসাটা খুব মনে পড়ে আজও। বাবা থমথমে মুখে হাঁটছে। মা কাঁদছে ডুকরে ডুকরে। দুজনের কেউই রতনের দিকে তাকাচ্ছে না। এগিয়ে যাচ্ছে তাকে পিছনে ফেলে। দু’সপ্তাহ ধরে অসুস্থ ছিল রতন। সে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে মা-বাবার পিছনে। মাঝে মাঝে পা টলে যাচ্ছে তার। আসার পথে তারা রিকশা করে এসেছিল। এখন রিকশার কথা কেউ বলছে না।

সে দিন থেকেই চার দিকটা কেমন যেন বদলে গেল রতনের। মা, বাবা, দি’ভাই, নবদা। খাঁ-খাঁ গ্রীষ্মে জলঙ্গির চেহারা যেমন বদলে যায়, শুকিয়ে এতটুকু হয়ে যায় জলের স্রোত, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ওঠে নদী, চুরচুর করে ধূলিকণায় পরিণত হয় নদীবক্ষের পলিমাটি, ঠিক তেমনই এক লহমায় কে যেন শুষে নিল রতনের ঢিলেঢালা, শান্ত পরিবারটাকে।

হাসপাতাল থেকে ফিরে নিজের ঘরে আর ঠাঁই হয়নি রতনের। নিজের ঘর মানে ছোটদের ঘর। যে ঘরে ঘেঁষাঘেঁষি করে কাকিমার সঙ্গে তারা ছোটরা শুত— সে, ভাই আর পুতুল। ঘর আর কোথায় পাবে সে? ওই তো ছোট্ট বাড়ি ছিল তাদের। দরমার বেড়া, টালির ছাদ। মাটির দাওয়া। একটা ঘরে মা আর বাবা। নবদা শুত বাইরে। হাসপাতাল থেকে ফিরেই মা বলেছিল, ‘তুই এখন ক’দিন রান্নাঘরে শো। ছোঁয়াচে রোগ থেকে উঠেছিস সবে। এখনও রোগ পুরোপুরি সেরেছে কি না কে বলবে। পুতুলের যদি ছোঁয়াচ লাগে, বকুলের? আর হ্যাপা নিতে পারব না বাবা।’ পুরোপুরি যখন সেরে উঠেছিল সে, তখনও কিন্তু রান্নাঘর ছেড়ে ঘরে এসে শোওয়ার আর অনুমতি মেলেনি।

ওটা এমনই একটা বয়স, বিনা প্রশ্নে অনেক কিছুর সঙ্গেই মানিয়ে নেওয়া যায়। একটু একটু করে মানিয়ে নিতেই কাকিমার মুখঝামটা শিখল সে। দি’ভাই তাকে যেন আর দেখতেই পেত না! সে যেন নেই। আর নিজে থেকে এসে কথা বলা! ঘরের মধ্যে তো দূরে থাক, তার ধারেপাশে ঘেঁষাও বন্ধ করে দিল। সেটাও মানিয়ে নিতে শিখল রতন। আর মানিয়ে নিতে শিখল
খিদের সঙ্গে।

আগে দু’বোনের সঙ্গে খেতে দেওয়া হত রতনকে, যেখানে সবাই খায়। এখন সে খায় ভিতরের দাওয়ায়, একা। বাড়ির সবার খাওয়া হলে, রান্নাঘরের মেঝেতে। তবে বেশির ভাগ দিন খেতে বসে দেখে, সামান্য একটু ভাত আর ডাল পড়ে আছে। কোনও কোনও দিন দেখে তাও নেই, আছে সামান্য একটু সুক্তো বা ছেঁচকি। তাতে পেট ভরে না রতনের। আজকাল সকালে উঠে মা আর আগের মতো তাকে কিছু খেতে দেয় না। অনেক দিন দুপুরেও কিছু দেয় না। খুব খিদে পেলে, ভয়ে ভয়ে একটু চিঁড়ে চায় রতন, ‘মা, একটু চিঁড়ে আছে গো, দেবে?’ তখন দেয় একটু।

এ সব মানিয়ে নিত রতন। ইস্কুলে যাওয়াটা যে বন্ধ হয়ে গেল, এটাই তাকে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা দিয়েছিল। সে তো ভাল ছাত্র ছিল। অঙ্ক দিদিমণি, ইংরিজি স্যর, বাংলা স্যর তাকে ভালবাসতেন। সে তো এ বারের ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট! কিন্তু এখন আর নাকি নতুন ক্লাসে তাকে নেবে না। হিজড়েদের নাকি ইস্কুলে যাওয়ার নিয়ম নেই।

ওই শব্দটা সে আগে কখনও শোনেনি। এখন উঠতে-বসতে শুনতে হয় তাকে। কাকিমা বলে, মা বলে।

‘তুই হিজড়ে! কোন পাপে হিজড়ের জন্ম দিয়েছিলাম! হিজড়েকে বাড়িতে পুষতে হচ্ছে। তুই চলে যা, চলে যা, মুক্তি দে আমাদের! যে দিকে দু’চোখ যায় চলে যা! মুক্তি দে তুই। তোর পায়ে পড়ি!’

• (ক্রমশ) •

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE