কালিম্পং শহরটার পেটে পেটে যে এত ব্যস্ততা, হিউস্টন গত কাল আঁচ করতে পারেনি। ভারতে হিউস্টনের এই প্রথম আসা। কলকাতা থেকে ট্রেন ধরে শিলিগুড়ি, সেখান থেকে বাসে চেপে গত সন্ধ্যাতেই সে কালিম্পং পৌঁছেছে। সকালবেলায় এখন তাকে যেতে হবে শহরের ব্রিটিশ ট্রেড এজেন্টের কাছে।
এজেন্টের অফিস বাজার এলাকায়, দাঁড়িয়ে আছে একের পর এক ঘোড়া আর খচ্চর। রাস্তা জুড়ে মালপত্রের বড় বড় গুদাম, একটা বাচ্চা ছেলে ছুটতে ছুটতে বলছে, ‘ক্যারাভান পৌঁছে গেছে।’
ঘোড়া আর খচ্চরের ক্যারাভান নিয়ে সীমান্তের এই পাহাড়ি শহরের যতেক ব্যস্ততা। পাশের সিকিম আর তিব্বত থেকে এখানে আসে হরেক রকম উল, চালান যায় খাবারদাবার, পোশাক থেকে ট্রানজিস্টর, হরেক কিছু। সিকিম আর তিব্বতের এক জন করে এজেন্ট এখানে আছে, তাদের থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে ক্যারাভান ফের সময়মত এই শহর ছেড়ে স্বদেশে রওনা হয়।
হিউস্টনের অবশ্য এ রকম অনুমতিপত্র পাওয়ার কথা নেই। তার ভাই সিনেমা তৈরির এক টিমের সঙ্গে এভারেস্ট পর্বতশিখরের দিকে রওনা হয়েছিল, আর ফেরেনি। ধস এবং তুষারঝড়ের খবর পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু তাতে ভরসা নেই। ক্যারাভানের সঙ্গে আসা একটি লোক জানিয়েছে, ঝড়ের এক মাস পর তাদের সঙ্গে মাঝপথে তিন জন ব্রিটিশ যোগ দেয়। কিন্তু সকালে তারা তাঁবু থেকে বেরিয়ে অন্য দিকে রওনা হয়। কোথায় গেল? ওই দলেই কি ছিল তার ভাই? কিন্তু বাড়ি না ফিরে তিব্বতেই রয়ে গেল কেন তারা? এই কালিম্পং থেকেই রহস্য উদ্ঘাটন শুরু করতে হবে হিউস্টনকে।
এই কাহিনি ১৯৫০ সালের। ‘ফেবার অ্যান্ড ফেবার’ থেকে মাস কয়েক আগে ফের ছেপে বেরিয়েছে লায়েনেল ডেভিডসনের ‘দ্য রোজ অব টিবেট’। ষাটের দশকে এই থ্রিলার বেশ সাড়া জাগিয়েছিল, গ্রাহাম গ্রিন থেকে অনেকেই তুমুল প্রশংসা করেছিলেন। সেই ’৫০-এ তেনজিং নোরগে এভারেস্টে পা রাখেননি, দলাই লামা তিব্বত ছাড়েননি। রহস্যভেদে শেষ অবধি কালিম্পং থেকে সীমান্ত পেরিয়ে হিউস্টন চোরাগোপ্তা তিব্বত ঢুকে পড়ে, সেখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের এক মঠে তার ভাইকে শেষ দেখা গিয়েছে। অতঃপর সুন্দরী এক ভিক্ষুণীর সঙ্গে হিউস্টনের প্রেমপর্ব, দুজনে মিলে তিব্বত ছেড়ে পালাতে শুরু করে। তারা বুঝে গিয়েছে, সামনে ঘোর বিপদ। তিব্বত আর নিজের মতো থাকতে পারবে না, ঢুকে আসছে চিনা সৈন্য। প্রায় ৫০ বছর আগের ব্রিটিশ উপন্যাস টের পাইয়ে দেয়, বাংলার নতুন জেলাসদর কালিম্পং একদা বাণিজ্যশহর হিসেবে কী রকম খ্যাতিমান ছিল!
এখানেই দার্জিলিং আর কালিম্পং-এর তফাত। দার্জিলিং মূলত ব্রিটিশদের হাতে গড়া চা-বাগান, টয় ট্রেন আর স্যানাটোরিয়ামের শৈলশহর। কালিম্পং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথের। ১৯৩৪ সালে রাহুল সাংকৃত্যায়নও তিব্বত যাচ্ছেন কালিম্পং হয়েই।
শুধু রাহুল নন। রুশ অভিযাত্রী, চিত্রশিল্পী নিকোলাস রোয়েরিখ তখন সস্ত্রীক বাস করেন কালিম্পং-এ ‘ক্রুকেটি হাউস’ নামে এক বাংলোয়। থাকেন তিব্বতচর্চার গ্রিক বিশেষজ্ঞ প্রিন্স পিটার। ডেনিস ফিলিপ এডওয়ার্ড লিংউড নামে এক ব্রিটিশ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সেনাবাহিনীর রেডিয়ো ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুরে এসেছিলেন। যুদ্ধ থামার পর তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিলেন, নাম হল সঙ্ঘরক্ষিত। এই সঙ্ঘরক্ষিত প্রায় ১৪ বছর কালিম্পং-এ ছিলেন, ভারতের এখানে-ওখানে দলিতদের বৌদ্ধ ধর্মে নিয়ে আসতেন। তাঁর বন্ধু অম্বেডকর বৌদ্ধ মতে ধর্মান্তরিত হওয়ার সময়, ১৯৫৬ সালের ১৪ নভেম্বর সঙ্ঘরক্ষিতকে আচার্য হিসেবে থাকতে বলেন। সঙ্ঘরক্ষিত নিজে সে দিন থাকতে পারেননি। পরে প্রায় ২ লক্ষ দলিত তাঁর কাছে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়।
ভিক্ষু, শিল্পী ছাড়াও আন্তর্জাতিক সীমান্তের এই বাণিজ্যশহরে আছে অনেক গুপ্তচর। এখানেই বাসা বেঁধে আছেন মঙ্গোলিয়ার ভিক্ষু দাওয়া সাংপো। দাওয়া পরে ‘এ জাপানিজ এজেন্ট ইন টিবেট’ নামে স্মৃতিকথায় জানিয়েছিলেন, তাঁর আসল নাম হিসাও কিনুরা। চিনাদের খবরাখবর রাখতে মঙ্গোলিয়ান ভিক্ষু সেজে তিনি চরবৃত্তি করতেন। তিব্বত বিশেষজ্ঞ প্রিন্স পিটারকেও নেহরুর আমলে ভারতছাড়া হতে হয়। নেহরু জেনে গিয়েছিলেন, কালিম্পংবাসী এই গ্রিক পণ্ডিত আসলে গুপ্তচর। কালিম্পং তখন চিনের চেয়ারম্যানকেও মাঝে মাঝে টলমল করিয়ে দেয়। ১৯৫৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি চিনে মাও জে দং-এর বক্তৃতা: ভারতে কালিম্পং নামে একটা জায়গা আছে। মার্কিন আর ব্রিটিশ গুপ্তচরদের ঘাঁটি। কালিম্পং-এ বসে ওরা তিব্বতকে নড়বড়ে করে রাখতে চাইছে।
মাও-এর রাগ থাকাই স্বাভাবিক। কালিম্পং যে কুখ্যাত গুপ্তচর ঘাঁটি, সে বিষয়ে তিনি ও চৌ এন লাই বারবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ভবি ভোলেনি। ১৯৫৬ সালে বুদ্ধের আড়াই হাজারতম জন্মোৎসব, দলাই লামাও এসেছেন। তিনি নেহরুর কাছে কালিম্পং যাওয়ার কথা পাড়লেন, নেহরু প্রথমে নাকচ করে দিলেন। পরের দিন নিজেই তিব্বতি ভিক্ষুকে ডেকে বললেন, ‘এটা গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে খুশি যাবেন।’ কালিম্পং শুধু লেপচা-অধ্যুষিত একটি জেলা নয়, আর একটু বেশি।
এই কালিম্পং প্রেমের। একদা এখানকার আর্কেডিয়া লজ-এ সংসার পেতেছিলেন আসিন তিক সু মিৎ ফায়া লাট। আসিন ভারতে নির্বাসিত, বর্মার (মায়ানমার) শেষ রাজা থিব-এর মেজো মেয়ে। কিন মুং লাত নামে এক সাধারণ বর্মি পুরুষের প্রেমে পড়েছিলেন। রাজা ও রানি তাঁকে ত্যাজ্য করেন। মা-বাবা চান না, রাজবংশের বাইরে মেয়ের বিয়ে হোক!
কিন্তু রাজকন্যার জেদ! কিন মুং লাতকে নিয়ে আসিন চলে এলেন কালিম্পং, ব্রিটিশদের দেওয়া মাসিক ৫০০ টাকার পেনশন সম্বল। কিন মুং চাকরি-বাকরি করেন না, কিন্তু তাঁর লাইব্রেরিতে অজস্র বইয়ের সম্ভার। সঙ্ঘরক্ষিত থেকে রোয়েরিখ, সকলে তাঁর বাড়ির পার্টিতে আসেন। কিন মুং মাঝে মাঝে নেওড়া ভ্যালির জঙ্গলে শিকারে যান। সন্তানহীন দম্পতি একে অন্যকে কাছছাড়া করেন না।
স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া পেনশন বন্ধ, দম্পতির আর্থিক অবস্থা তলানিতে। রাজকন্যাকে তখন গয়না বন্ধক দিয়ে দিন চালাতে হয়। হৃদরোগে ১৯৫৫ সালে মারা গেলেন কিন মুং। শ্মশানের খরচও বাড়িতে নেই, ব্রিটিশ বৌদ্ধ সঙ্ঘরক্ষিত দু’হাজার টাকা ধার করলেন। শববাহকেরা রওনা হয়েছে, রাজকন্যা সন্ন্যাসীর কানে কানে বললেন, ‘ওঁকে চন্দনকাঠের চিতায় দেবেন। আমাদের রাজপরিবারে চন্দনকাঠ ছাড়া চিতা সাজানো হয় না।’
গরিবের আবার চন্দনকাঠ! কাঠের ওপরেই সে দিন ছড়িয়ে দেওয়া হল চন্দনগুঁড়োর প্যাকেট। রাজকন্যাও আর বেশি দিন বাঁচেননি। পরের বছর কলকাতার পিজি হাসপাতালে এক ফ্রি বেডে শেষ নিশ্বাস ফেললেন। শেষ হল বাড়ির অমতে প্রেম আর বিয়ের রাজকীয় অধ্যায়।
তবু এই ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-তেই জেলাসদরের সম্মান পেল কালিম্পং। ইতিহাস মোছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy