Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নানান নেতার মেজাজ মর্জি

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যখন দূরদর্শনের মাধ্যমে নির্বাচনী সম্প্রচারের সুযোগ পেল, সেটা বিশেষ উৎসাহ-উত্তেজনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিভিন্ন বারে নির্বাচনী সম্প্রচারের দায়িত্ব আমার উপর বর্তেছে বলে অনেক বড় বড় নেতাদের স্বভাব, মেজাজ কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে।

নির্বাচনী সম্প্রচারের রেকর্ডিংয়ে দূরদর্শন স্টুডিয়োতে জ্যোতি বসু, সঙ্গে পঙ্কজ সাহা।

নির্বাচনী সম্প্রচারের রেকর্ডিংয়ে দূরদর্শন স্টুডিয়োতে জ্যোতি বসু, সঙ্গে পঙ্কজ সাহা।

পঙ্কজ সাহা
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যখন দূরদর্শনের মাধ্যমে নির্বাচনী সম্প্রচারের সুযোগ পেল, সেটা বিশেষ উৎসাহ-উত্তেজনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিভিন্ন বারে নির্বাচনী সম্প্রচারের দায়িত্ব আমার উপর বর্তেছে বলে অনেক বড় বড় নেতাদের স্বভাব, মেজাজ কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে।

তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে অজিত পাঁজা এলেন এক বার। গাড়ি থেকে নামছেন, আমার এক সিনিয়র সহকর্মী বলদেব রাজ ওয়াধন আমাকে ইঙ্গিত করলেন, অজিত পাঁজার জামায় বুকের কাছে তৃণমূলের জোড়াফুলের প্রতীক। বললাম, দেখেছি, ঠিক সময়ে বলব। তিনি বললেন, তুমি বোলো না, তুমি তো লোকাল লোক, আমি বলব। ওয়াধনজি এসেছিলেন দিল্লি থেকে। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুসারে এই সম্প্রচারের সময় বক্তার দলের একটিই প্রতীক থাকবে পিছনে। ওয়াধনজি বললেন, স্যর, আপনাকে তো পাঞ্জাবি বদলিয়ে আমাদের ওয়াড্রোবের একটা পাঞ্জাবি পরতে হবে। অজিত পাঁজা বললেন, ‘কেন, আপনার কি আমার পাঞ্জাবিটা পছন্দ হচ্ছে না?’ আমি বললাম, তা না অজিতদা, উনি বলছিলেন পাঞ্জাবিটা এত সুন্দর, কিন্তু তাতে যে দলের প্রতীক আছে। অজিতবাবু বললেন, ‘আমার বুকে যে প্রতীকটা আঁকা হয়ে আছে, সেটা বাইরেও রেখেছি, তাতে আপত্তি কেন?’ ওয়াধনজি বললেন, এটা নির্বাচন কমিশনের নিয়মবিধির বাইরে। তার পর তুমুল তর্ক। অজিত পাঁজা বললেন, ‘এই পাঞ্জাবি পরেই আমি রেকর্ড করব, তা না হলে চললাম।’ অনেক চেষ্টা করলাম তাঁকে নিরস্ত করতে। কিন্তু তখন তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ। মুকুল রায়কে সব জানালাম। তিনি বললেন, ‘কিছু চিন্তা করবেন না, অন্য কাউকে পাঠাব।’

এক বার, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এসে বললেন, ‘শুনুন, আমার বাংলা পড়াটা খুব ফ্লুয়েন্ট হয় না, আমি কিন্তু অনেক সময় নেব।’ বললাম, নিশ্চয়ই। তিনি বাধ্য ছাত্রের মতো রিহার্সাল করতে আরম্ভ করলেন। রেকর্ড করে ওঁকে শোনাতেই, বললেন, ‘ভেরি ব্যাড, খুব খারাপ পড়েছি। বাড়িতে ভাল করে রিহার্সাল করে কাল আবার আসব।’ পর দিন যখন এলেন, বোঝা গেল, সত্যিই তৈরি হয়ে এসেছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিরোধী নেত্রী। এলেন ঝড়ের বেগে। এসেই বললেন, ‘কই আপনারা রেডি তো, বলুন কোথায় বসতে হবে।’ মেক-আপ শিল্পী এসে বললেন, একটু মেক-আপ করতে হবে দিদি। ‘কী? মেক-আপ! আমি জীবনে কোনও দিন মেক-আপ করিনি! বরং তাড়াতাড়ি রেকর্ডটা করে আমাকে ফ্রি করে দিন, অনেক কাজ ফেলে এসেছি।’ ঝড়ের বেগে রেকর্ডিং শেষ করলেন। বললাম, এক বার শুনে নিন রেকর্ডিংটা, আপনি খুশি কি না। বললেন, ‘এত সময় নেই পঙ্কজদা, আপনারা বরং শুনে নিন।’ বললাম, একটু চা খেয়ে যাবেন তো! বললেন, ‘এখন চা-টা খাওয়ার সময় নেই, তবে ইলেকশন হয়ে যাক, এক দিন এসে আপনাদের সঙ্গে বসে চা খাব, গল্প করে যাব। আজ সবাইকে নমস্কার।’ ঝড়ের বেগেই চলে গেলেন।

আমি তখন শান্তিনিকেতনের দূরদর্শনের দায়িত্বে। বিরোধী নেত্রী মমতা এসেছেন শান্তিনিকেতনে। আমাদের টিম নিয়ে গিয়েছি কভারেজে। পুলিশকর্তা বললেন, এ কী, আপনারা এখানে কেন? বললাম, কাল যখন মুখ্যমন্ত্রী এসেছিলেন, তখন তো আমাদের দেখে এ কথা জিজ্ঞেস করেননি? কালকেরটা নিউজ ছিল, আজকেরটাও নিউজ। টিমকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে অফিসে চলে এলাম। টিম ফিরলে জানতে পারলাম, আলাদা করে তারা মমতার বক্তব্য নিতে পারেনি। ছুটলাম ওঁর কাছে সার্কিট হাউসে। বললাম, দূরদর্শনের জন্য এক্সক্লুসিভ কিছু না বললে কী করে হবে! বললেন, ‘সে আপনার টিম আগে বলল না কেন? দেখুন এখন তো আমি চান করতে যাচ্ছি, তার আগে সব জামাকাপড় কাচাকাচি করতে হবে। আমি নিজের কাজ নিজে করি।’ বললাম, দিন আপনার কাচাকাচি সব আমি করে দিচ্ছি, আপনি একটু এই চেয়ারে বসে বলে দিন। বললেন, ‘দেখুন পঙ্কজদা, আপনাকে দেখে বোঝা যায় আপনি জীবনে কোনও দিন নিজের রুমালটাও কাচেননি।’ সারেন্ডার করতে হল। হাসতে হাসতে বললাম, দশ মিনিটের বেশি নেব না। মমতা বললেন, ‘চলুন, কোথায় আপনাদের ক্যামেরা।’

জ্যোতি বসু এলেন ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে। স্টুডিয়োতে নিয়ে গেলাম। সত্যজিৎ রায়ের মেক-আপ ম্যান অনন্ত দাশ তখন আমাদের মেক-আপ শিল্পী। তিনি তৈরিই ছিলেন। জ্যোতিবাবু বললেন, ‘মেক-আপ! আমাকে!’ অনন্তদা বললেন, না, মানে স্যর, একটু পাউডারিং করে দিলে আপনার মুখের ঘামটা চলে যাবে। আপত্তি করলেন না, শুধু সেই প্রায়-অদৃশ্য হাসির রেখাটা ফুটে উঠল। এক বারেই রেকর্ডিং শেষ করলেন, কোনও থামাথামি নেই। শোনানোর পর জিজ্ঞেস করলাম, ইমপ্রুভ করার জন্যে আর এক বার করবেন? বললেন, ‘অফিসে অনেক কাজ ফেলে এসেছি।’

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন মুখ্যমন্ত্রী। গাড়ি থেকে নেমে, ফুলের স্তবক হাতে নিয়ে হেসে বললেন, ‘এ কী, আপনারা সবাই আমার জন্যে বাইরে অপেক্ষা করছেন! আপনাদের তো ইলেকশনের আগে এখন অনেক কাজ, আমি আপনাদের সময় নষ্ট করলাম।’ রেকর্ডিং শুরু হতেই বুঝলাম, তাঁর নিজেরই লেখা স্ক্রিপ্ট, কোনও রিহার্সাল দরকার নেই ওঁর। রেকর্ডিং শোনার পর বললেন, ‘আপনাদের ক্যান্টিনটা কোথায়, কাছাকাছি চায়ের দোকান আছে? চলুন একটু চা খেয়ে আসা যাক।’ বললাম, আপনার জন্য তো চায়ের ব্যবস্থা আমরা করে রেখেছি। বললেন, ‘ক্যান্টিনে গেলেই ভাল লাগত।’

প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। রেকর্ডিংয়ে আসবেন সে দিন। আমার মোবাইলে ফোন করলেন, ‘আমি ঠিক সময়েই পৌঁছে যাব, তবে আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আমার স্ক্রিপ্টে কিছু পরিবর্তন আছে, সেটা কি আপনি নিজেই অ্যাপ্রুভ করতে পারবেন, না কি আবার আপনাদের কমিটির কাছে পাঠাতে হবে?’ বললাম, যদি তেমন বেশি পরিবর্তন না থাকে, কমিটির কাছে পাঠানোর দরকার হবে না। বললেন, ‘আমার স্ক্রিপ্টটা সামনে আছে? তা হলে দেখুন, দুইয়ের পাতায় একেবারে শেষের দিকে ‘জনসাধারণের মনে’ আছে, ওটা ‘মনেও’ হবে, একটা ‘ও’ যোগ হবে। চারের পাতায় প্রথম প্যারায় ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য’ আছে, ওটা হবে ‘শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য।’ শুনে আমি হাসতে লাগলাম। উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হল?’ আমি বললাম, এটা তো আপনার বলার কোনও দরকার ছিল না। উনি বললেন, ‘তা কী করে হয়, এটা পরিবর্তন তো।’ এই হচ্ছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, এতটা নিখুঁতপন্থী। তার ক’দিন আগেই প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি আমাকে বলেছিলেন, প্রণবদা তো রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন। একটু নিরিবিলিতে পেয়ে ওঁকে কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, ‘মিসেস গান্ধী তো এখনও আমাকে কিছু বলেননি।’ সে বার রাষ্ট্রপতি হননি, পরের বার হলেন। জানতাম, এক দিন শীর্ষে যাবেনই।

pankajsaha.kolkata@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pankaj Saha Magic Box Jyoti Basu Rabibasariya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE