Advertisement
E-Paper

একেই বলে অ্যাডভেঞ্চার

যে পথ সবাই যায় হেলিকপ্টারে, সেটাই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাঁচ দিন ধরে যাওয়া। কখনও দড়ি বেয়ে গভীর খাদ পেরনো, কখনও পায়ের তলার মাটি ধসে প্রাণসংশয়। কার্স্টেনজ শৃঙ্গজয়ের পথে তিরধনুক, রামদা হাতে পাহারা দেয় বন্ধু আদিবাসীরা। যে পথ সবাই যায় হেলিকপ্টারে, সেটাই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাঁচ দিন ধরে যাওয়া। কখনও দড়ি বেয়ে গভীর খাদ পেরনো, কখনও পায়ের তলার মাটি ধসে প্রাণসংশয়। কার্স্টেনজ শৃঙ্গজয়ের পথে তিরধনুক, রামদা হাতে পাহারা দেয় বন্ধু আদিবাসীরা।

সত্যরূপ সিদ্ধান্ত

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৮:১০
গর্বিত: কার্স্টেনজ-এর চুড়োয় ভারতের পতাকা হাতে লেখক।

গর্বিত: কার্স্টেনজ-এর চুড়োয় ভারতের পতাকা হাতে লেখক।

বা ইরে হঠাৎ কিসের একটা আওয়াজে তন্দ্রাটা ভেঙে গেল। দু’দিন ধরে হেলিকপ্টার আসবে-আসবে করছে। কিন্তু এসে পৌঁছয়নি। খাবার প্রায় তলানিতে। কানাডার পবর্তারোহী বন্ধু ক্রিস্টোফারের দেওয়া ফিল্টার লাগানো বোতল থেকে একটু জল মুখে দিয়ে শুষে নিলাম। গলাটা ভিজল। ভাগ্যিস টলমলে নীল হ্রদটা টেন্ট থেকে দু’পা দূরেই! পাশ ফিরে দেখলাম, নন্দিতা এখনও ঘুমোচ্ছে। এ বার আওয়াজটা আর একটু স্পষ্ট হতেই একটা ঠান্ডা শিহরন খেলে গেল শরীরে। রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আওয়াজটা তো কেভিন কস্টনার-এর ‘ডান্সেস উইথ উল্ভস’ সিনেমার যুদ্ধদৃশ্যে নেটিভ ইন্ডিয়ানদের চিৎকারের আওয়াজের মতো লাগছে! মুসা তো বাইরে বেরল একটু আগেই। অজানা আতঙ্ক গ্রাস করে নিল নিমেষে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। নিমেষে পাসপোর্ট সহ টাকাগুলো নিয়ে স্লিপিং ম্যাটের নীচে পাচার করে দিলাম। আর ক্যামেরার ব্যাগটা স্লিপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম। সামিটের সব ছবি আছে ওই ক্যামেরায়। যা-ই ঘটে যাক, বেঁচে থাকলে মেমরি কার্ডটা যেন ঠিকঠাক নীচে নিয়ে যেতে পারি। লরেনের দিকে তাকালাম। লরেন লাফিয়ে উঠে একটা চাকু বের করল। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। একটা হাতা আর একটা ওয়াকিং পোল তুলে নিলাম দু’হাতে। অস্ত্র! জঙ্গলের জনজাতিরা আক্রমণ করেছে! রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি, কখন তারা ঝাপিয়ে পড়বে আমাদের উপর। আওয়াজটা এ বার কাছে আসতেই দু’জনেই হেসে ফেললাম। চারটে বন্য কুকুর একসঙ্গে ডাকতে ডাকতে দৌড়চ্ছে, তাদের আওয়াজ পাহাড়ে ইকো হওয়াতে এই অদ্ভুত আওয়াজের সৃষ্টি করেছিল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু আতঙ্ক যে কী, সে দিন ‘কার্স্টেনজ পিরামিড’-এর বেস ক্যাম্পের সামিট হয়ে যাওয়ার পরে আটকে থাকা সময়ে বুঝলাম।

ইন্দোনেশিয়া, পশ্চিম পাপুয়া প্রভিন্সে নিউ গিনি দ্বীপের কার্স্টেনজ ওশিয়ানিয়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। প্রতিটি মহাদেশের সর্বোচ্চ শিখর আরোহণ করাকে বলে সপ্তশৃঙ্গ আরোহণ করা বা ‘ক্লাইম্বিং দ্য সেভেন সামিটস’। বিশিষ্ট পর্বতারোহী রেনহোল্ড মেসনার-এর মতো অস্ট্রেলিয়ার উচ্চতম শৃঙ্গ কসিউস্কো নয়, কার্স্টেনজ-এর হওয়া উচিত। কারণ অস্ট্রেলিয়ার টেকটনিক প্লেট ধাক্কা খেয়েছে পাপুয়া অঞ্চলে। এটা নিয়ে মতভেদ আছে। ইউরোপের মঁ ব্লাঁ আর এলব্রুস আরোহণ করেছি, কার্স্টেনজ-ই বা বাদ যায় কেন? তাই ডিসেম্বরে অ্যান্টার্কটিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ভিনসন ম্যাসিফ-এর আগে কার্স্টেনজ-এর স্বপ্নটাও বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। বেশির ভাগ লোকেরাই কার্স্টেনজ আরোহণ করতে হেলিকপ্টার রুট নেয়। আমরা কিছুটা জোর করেই জঙ্গলের রাস্তা ধরব ঠিক করেছিলাম। এজেন্সির হাজার মানা করা সত্ত্বেও। কারণ এই জঙ্গল দিয়ে যাওয়াটাই একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা।

জনৈক বাঙালি প্রবীর দে-র উদ্যোগে আসিয়ান-এর ৫০ বছর উপলক্ষে ১২টা দেশের রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতে আমাদের পতাকা প্রদান অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় আসিয়ান-এর হেড কোয়াটার্স জাকার্তাতে। ভারতের দূতাবাস এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হল ভারতের জাতীয় পতাকা। সঙ্গে দেওয়া হল আসিয়ান আর ইন্দোনেশিয়ার পতাকাও। এরই মাঝে আমাকে একটি দেশের রাষ্ট্রদূত এসে বললেন, ‘‘তুমি কার্স্টেনজ পিরামিডের যাচ্ছ জঙ্গল রুট দিয়ে! ইন্দোনেশিয়ার লোকেরাও ও ভাবে যেতে ভয় পায়।’’ মুচকি হেসে সে দিন বলেছিলাম, ‘‘ওটাই তো অ্যাডভেঞ্চার!’’

জার্কাতা থেকে বালি। সেখান থেকে মাকাসা হয়ে নাবিরে পৌঁছনো, তার পর সোজা সুগাপা। চমকানো শুরু সুগাপা এয়ারপোর্টে নেমে। খালি এয়ারস্ট্রিপ, এয়ারপোর্ট নেই। সবুজ পাহাড়ের ভিতর থেকে উঁকি মারছে পরিষ্কার ঝকঝকে এয়ারস্ট্রিপ। যদিও অনেকটাই বড়। সবুজ পাহাড় চারপাশে। মুগ্ধ হয়ে দেখছি, ঠিক তখনই কানে এল কিছু বাইকের আওয়াজ। ঠিক শুনলাম তো? এয়ারপোর্টে মোটরবাইক? দেখি, সত্যি বেশ কয়েকটা বাইক ঢুকে পড়েছে। আরোহীদের মধ্যে কয়েক জনের হাতে বড় রামদা, কারও হাতে তির-ধনুক। তিরগুলোতে কি বিষ লাগানো আছে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম লরেনকে। লরেন বলল, ‘‘বোধহয় না।’’ লরেন আর রমি আমাদের গাইড। হঠাৎ দেখি ওরা আমাদের ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করছে। করে কী! রমি হাসছে, ‘‘ওরা আমাদের ব্যাগ নিয়ে যাবে, সঙ্গে আমাদেরও।’’ এখানে গাড়ি নেই। আগে হেঁটে হেঁটে গোটা এক দিন লাগত সুয়াঙ্গামা গ্রামে পৌঁছতে। এখন বাইক-বাহিনীর সাহায্যে এক ঘণ্টাতেই হয়ে যায়।

কুঠার, রামদা হাতে স্থানীয় পাহারাদার বন্ধুরা

বাইক ছুটল। মাঝে পুলিশ স্টেশন আর আর্মি স্টেশনে অনুমতি নেওয়ার জন্য দাঁড়াতে হল। ওরা বলে দিল, কিছু অঘটন বা দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় আমাদের। প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য ওরাও চলল ওদের বাইক নিয়ে। এক জন পুলিশ আর তিন জন মিলিটারি। বাইক ছুটল। কোথায় লাগে লে লাদাখের বাইকিং? অফ রোড, জলপ্রপাত, ল্যান্ডস্লাইড, পাথুরে রাস্তা, কাদা, খাদের ধার বেয়ে উঁচুনিচু সব রাস্তা দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে নিয়ে গেল। মাঝ রাস্তায় তিন জন বাইক থেকে উলটে পড়ল। অন্যরা বলল, নতুন এসেছে, শিখে যাবে।

সুয়াঙ্গামা গ্রামে পৌঁছনো মাত্র উৎসাহী জনতা আমাদের দেখতে এল। কাঁধে তির-ধনুক, হাতে রামদা আর মুখে হাসি। আফ্রিকার আদিবাসীদের মতো এরাও মাথায় ছোট ছোট করে বিনুনি বাঁধে। তবে সকলে নয়। বাড়িগুলো গোল। দু’টো দরজা। আর আছে একটা চিমনি। সারা ক্ষণ আগুন জ্বলে। ঘরে এক বার ঢোকার চেষ্টা করলাম। ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার। দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। কাশতে কাশতে বেরিয়ে এলাম। ওরা কী ভাবে থাকে কে জানে! আসবাবহীন ঘরে মাদুর ছাড়া বসবার আর কিছু খুঁজে পেলাম না। ছাদে সবুজ লতাপাতার গাছ। তার ভিতরে বসে এক মহিলা সুতো দিয়ে বুনে চলেছেন রঙিন ব্যাগ। মেয়েরা মুখে উল্কি করেন। পাপুয়ার সবচেয়ে বড় জনজাতি হল এই ‘দানি’। আর একটি জনজাতির নাম ‘মনি’। দানি ও মনি গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে কথা যেমন হয়, মতপার্থক্যও হয়। কিন্তু সেই মতপার্থক্য যখন আলোচনাতে মেটে না, তখন ভরসা একমাত্র যুদ্ধ। যুদ্ধ হয় তির-ধনুক দিয়ে, পূর্বনির্ধারিত সময়ে এবং জায়গায়। যুদ্ধ শেষ হবে সন্ধের আগে। গোনা হবে, কত জন আহত আর কত জন নিহত। যে পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি কম হবে, তারা জিতবে।

এই যুদ্ধে বহু বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে উইলিয়ামস। সে-ই এখন এই গ্রামের চিফ। প্রথম দেখায় একটু আশাহতই হয়েছিলাম। উইলিয়ামসের পরনে একটা ছেঁড়া টি-শার্ট আর একটা বারমুডা, খালি পা! একটু ভারী শরীর। অথচ কী সরল হাসি! বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হাসে একেবারে। গোটা ট্রেকে সেই হাসি কত যে নকল করেছি!

সে দিন উইলিয়ামসের সরল হাসি দেখে লরেনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘এরা কি হিংস্র হয় কখনও?’’ লরেন বলল, ‘‘এমনিতে ওরা ভাল। তবে এক বার রমিকে এক জন আদিবাসী কেটে ফেলতে এসেছিল রামদা দিয়ে। সে কথা চিফের কানে পৌঁছায়। ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের মূল্য প্রাণ দিয়ে মেটাতে হয়েছিল সেই ব্যক্তিটিকে। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া এবং সেটা কার্যকর করার দায়িত্ব উইলিয়ামস নিজের হাতে নিয়েছিল!’’

কার্স্টেনজ বেস ক্যাম্পে পৌঁছনোর দু’টো রাস্তা আছে। একটা এই সুয়াঙ্গামা গ্রাম পেরিয়ে জঙ্গলের রাস্তা। আর একটা রাস্তা তিমিকা হয়ে ইলাগা গ্রাম হয়ে। কিন্তু সেই রাস্তায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উপদ্রব। দেখা হয়ে গেলে সব লুটে নেয়। কার্স্টেনজ ঢোকার তিন নম্বর রাস্তাও আছে, কিন্তু সেই রাস্তা দিয়ে কেউ যেতে পারে না। কারণ একটু এগোলেই রাখা আছে একটা তির আর একটা ধনুক। লক্ষ্মণরেখার মতো ওটা অতিক্রম করলেই উড়ে আসবে ঝাঁকে ঝাঁকে তির। তার পর আছে মাটিতে পেতে রাখা ফাঁদ। তিরের হাত থেকে বাঁচলেও, ফাঁদে পা পড়বেই। কোনও একটা লতায় পা পড়লেই এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে বর্শা। সেই গ্রামে এখনও সভ্যতা পৌঁছায়নি। জামাকাপড় কী, মানুষ জানে না। গায়ে এক ধরনের তেল মাখে, তাতে নাকি ঠান্ডা লাগে না। যদি ওদের চিফ চায়, তবেই সে অন্য কোনও গ্রামের চিফের সঙ্গে দেখা করবে। ভাবতেও গা শিরশির করে যে এই জঙ্গলেই আছে করোওয়াই জনজাতি যারা মানুষের মাংস খায়। কিন্তু সে জায়গা আরও অনেক দূরে। পাপুয়া নিউগিনিতে ঢুকে গিয়েছে।

শুরু হল আমাদের পথ চলা। সুয়াঙ্গামা গ্রাম ছাড়িয়ে শুরু হল জঙ্গল। গোটা পথটা হাঁটু পর্যন্ত কাদা। কিছু কিছু জায়গায় এক মানুষ সমান কাদা। সে সব জায়গা বাঁচিয়ে এগনো। রবারের বুট পরে চলেছি। এক-এক বার পা আটকে যাচ্ছে। বের করতে কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। তার মাঝে নদী পার হওয়া। এক জায়গায় এসে হাড় হিম হয়ে গেল। নদীর উপর সেতু, সেতু বলতে একটা বড় গাছের গুঁড়ি ফেলা আছে। শ্যাওলা জমে গিয়েছে। অনেকটা যেতে হবে তার উপর দিয়ে! ধরার কিছু নেই। আর পায়ে রবারের জুতো। এক-একটা মিনিট যেন এক-একটা ঘণ্টা। খরস্রোতা নদী নীচে। দোনামোনা করতে করতে হ্যান্ডিক্যামটাকে বের করে নিলাম। পিছনে মুসাও হ্যান্ডিক্যামে শ্যুট করে চলেছে। পড়ে গেলে রেকর্ড থাকবে। ও পারে পৌঁছনোর পর হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। অথচ এ রকমই জায়গা দিয়ে দানি জনজাতির এক জন কাঁধে বাচ্চা নিয়ে অনায়াসে পার হয়ে গেলেন, দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কী অসীম সাহস আর দক্ষতা এঁদের!

পর্বতপথে ঝুঁকি নিয়ে চলা

পাঁচ দিনের জঙ্গল-পথে দ্বিতীয় দিনে একটা সংকীর্ণ রাস্তা পেরোচ্ছি। রাস্তা বলে কিছু নেই। ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছে ট্রেলটা। অনেকটা ভেঙে গিয়েছে, তিন মিটার নীচ দিয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী। নন্দিতা আর লরেন এগিয়ে গেল কোনও মতে লতাপাতা ধরে। আমি একটুখানি এগিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে গোটা রাস্তাটা ল্যান্ডস্লাইড হয়ে ধসে গেল। কোনও রকমে লেপটে আছি। একটু নড়াচড়া করলেই পড়ে যাব নদীর মধ্যে। কিন্তু আর ভারসাম্য রাখা যাচ্ছে না। একটু একটু করে নেমে যাচ্ছি। প্রচণ্ড অসহায় লাগছে। নীচের অংশটা ঝপাস করে পড়ে গেল বর্ষার ফুলেফেঁপে ওঠা খরস্রোতা নদীতে। নিমেষে হারিয়ে গেল। হাতড়াতে হাতড়াতে একটা শেকড় পেলাম। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু আনন্দটা স্থায়ী হল না। শেকড়টা ধরতেই হাতে চলে এল শেকড়টা। আর রক্ষে নেই। তবু কোথা থেকে যেন অভয় শক্তি পেলাম। হাঁটু-কনুই-বুক-হাত-পা সব দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছি আরও কিছু ক্ষণ আটকে থাকার। লরেন বিন্দুমাত্র দেরি না করে টারজানের মতো একটা লতা ধরে ঝুলে পড়ল। ঝুলতে ঝুলতেই ওয়াকিং স্টিকটা বাড়িয়ে দিল। পর ক্ষণেই বুঝল ওয়াকিং স্টিক বাঁচাতে পারবে না। আরও টেনে টেনে লতাটাকে আমার হাতের নাগালে ধরিয়ে দিল। বেঁচে গেলাম। লরেন না থাকলে আমার কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যেত না।

বেস ক্যাম্পে থাকার সময় বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে দেখা হওয়াতে আমাদের গাইড রমি ও লরেন ভয়ে কুঁকড়ে গেল। সেই বিদ্রোহী গ্রুপের লিডারের ভাই এল যে! এ সে-ই, যে কয়েক বছর আগে কয়েক জন পুলিশ ও আর্মির লোকের গলা কেটে দিয়েছিল সিনেমার স্টাইলে। ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। আমরা তখন অপেক্ষা করছি হেলিকপ্টারের জন্য। উইলিয়ামসের বিশ্বস্ত ছয় জন তির-ধনুক ও রামদা নিয়ে আমাদের প্রোটেকশন দিচ্ছে। তারা আমাদের তাঁবুতে এল, চা খেল, জরিপ করল, শুনল যে আমরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চলে যাচ্ছি। তাই আমাদের ক্ষয়ক্ষতি কিছু করল না। যদি জানতে পারত, আমরা আরও পাঁচ দিন আটকে থাকব, আমাদের সব কিছু এক দু’দিনেই কেড়ে নিয়ে
চলে যেত।

স্বপ্ন দেখছি কি না বুঝতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিল ‘লর্ড অব দ্য রিংস’ সিনেমার ক্রিপ্ট। বা হয়তো কোনও একটা কোণ থেকে এ বার ডাইনোসরাস বেরিয়ে আসবে!

এর আগে ‘ভয়’কে চাক্ষুষ দেখিনি। দু’টো পাহাড়ের মাঝে একটা বিশাল খাদ, সেই জায়গাটা পেরোতে হয় দড়ির সাহায্যে। নীচে একটা দড়ি টাঙানো আছে— টানটান করে, এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। আর ঘাড়ের কাছে আরও দু’টো দড়ি, হাত দিয়ে ধরার জন্য। সেই জায়গা নন্দিতা ক্রস করছে, এমন সময় প্রচণ্ড ঝড় আর বৃষ্টির দুলুনি শুরু হল। দেখলাম নন্দিতার চোখেমুখে ভয়। সঙ্গে শুনলাম আমার নিজের বুকের ধ়ড়াস ধ়ড়াস শব্দ। নিজের উপর বিশ্বাসটা ফিরে এল, যখন সামিটের একটু আগেই অর্ধেক ছেঁড়া দড়িতে সেফটি লাগিয়ে ১০০০ মিটার খাদের উপর দিয়ে একটা আলগা পাথরে লাফ মেরে অন্য দিকে পৌঁছলাম। আর তৃপ্তি কী, সেটা অনুভব করলাম সামিট-এ পৌঁছে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।

কার্স্টেনজ বললে মনে পড়ে ক্যালেইডোস্কোপের মতো সেই দিনগুলোর কথা। যখন তুমুল শিলাবৃষ্টির মধ্যে মাথায় শিলের গাঁট্টা খেতে খেতে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি। যখন খিদের চোটে জঙ্গলের মানুষের মেরে আনা পাখি খেয়ে নিচ্ছি। নির্দ্বিধায় ইঁদুরের সঙ্গে মারামারি করে অভুক্ত অবস্থায় ক্যাম্প সাইটে ওদের ফেলে যাওয়া খাবার খোঁজ করছি। পাগলের মতো হেলিকপ্টারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য স্লিপিং ম্যাটটাকেও আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছি। সারভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট কাকে বলে, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। ছিল বটে একটা অভিযান। সত্যি তো, ‘ওটাই তো অ্যাডভেঞ্চার!’

Adventure Satyarup Siddhanta Mount Everest Mt Kilimanjaro Mt Elbru সত্যরূপ সিদ্ধান্ত
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy