Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

গঙ্গা-যমুনা শোধনের দরকার কী, হিন্দু-মুসলিম নিয়েই থাকি

বিচ্ছিন্ন উদ্ধৃতি সংগ্রহ করে এক মনীষীকে নিজের দলের নেতা বলে প্রমাণ করাটা পুরনো অভ্যাস। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালবিচ্ছিন্ন উদ্ধৃতি সংগ্রহ করে এক মনীষীকে নিজের দলের নেতা বলে প্রমাণ করাটা পুরনো অভ্যাস। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

দূষিত যমুনা নদী।

দূষিত যমুনা নদী।

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:১৫
Share: Save:

দিল্লিতে বরাবরই জলের অভাব।

আকবর যখন শাহি দিল্লির সম্রাট, তখন তাঁর উদ্যোগে যমুনা নদীর সংস্কার সাধনের কাজ শুরু হয়। এবং যমুনাকে আবার স্রোতস্বীনী করা হয়। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের রচনা থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়।

মোগল আমলে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিভাজন ছিল না এমন নয়। এমনকী, যে আকবর দীন-ইলাহির প্রতিষ্ঠাতা, তাঁর সময়েও জনজীবনে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ছিল। তবু সেই সময়েও অন্তত কিছু লোক যমুনার সংস্কার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন।

এমনকী, আকবরের রাজত্বের প্রথম দিকে ১৫৬০ সালে দিল্লির প্রশাসক শিহাবুদ্দিন খান যমুনার পশ্চিম দিকের খাল পুনরায় কেটে নতুন নাম দেন শিহাব নাহার।

২০১৫ সালে দাঁড়িয়ে এই শাহি দিল্লিতেই দেখছি, যমুনায় জল নেই। এক বীভৎস পরিস্থিতির শিকার এই ঐতিহাসিক নদীটি। এ দেশে কমনওয়েলথ গেমস হয়েছে। নগরায়ণের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে সেই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে। কিন্তু যমুনা সংস্কার সম্ভব হয়নি। অথচ, এই যমুনা থেকে অনতিদূরে দাদরি নামক একটি কার্যত অজানা প্রান্ত বিখ্যাত হয়ে উঠেছে গোমাংস ভক্ষণ বিতর্ককে কেন্দ্র করে।

ভারতে হিন্দু এবং মুসলমান বিভাজন নতুন ঘটনা নয়। সোমনাথ মন্দির যে ভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল, তাতে হিন্দু জনজীবনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। সাধারণ মানুষ সে দিন ভাবতে চাননি, যাঁরা ধ্বংসকর্তা, তাঁরা শাসক, তাঁরা শাসিত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আর শাসিত মানুষের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ই অন্তর্ভুক্ত। সেখানে রাম এবং রহিম দুই-ই আছেন। ব্রিটিশরা বিভেদ নীতি প্রয়োগ করেছিলেন। অনেকে বলেন, তাঁরাই ভারতীয় উপনিবেশে সাম্প্রদায়িকতাকে বাড়িয়েছেন বিভেদ নীতির মাধ্যমে তাঁদের রাজত্বকে পাকাপোক্ত করার জন্য।


আবর্জনা পড়ে রয়েছে গঙ্গায়

এই যুক্তি অবশ্য আধুনিক ঐতিহাসিকেরা পুরোটা স্বীকার করেন না। তাঁরা বলছেন, ভারতীয় পটভূমিতে এই সম্প্রদায়ের বিভাজিকা রেখাটি আগে থেকেই ছিল। ব্রিটিশরা প্রশাসনিক স্বার্থে সেটিকে কাজে লাগিয়েছে। ঠিক যে ভাবে শুধু সাম্প্রদায়িকতা নয়, কাজে লাগানো হয়েছে জাতপাতকেও।

এ বার সংসদের অধিবেশনে নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রস্তাব অনুসারে বাবাসাহেব অম্বেডকরকে নিয়ে দু’দিনব্যাপী আলোচনা হল। এই আলোচনাতেও বার বার মনে হল, কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল, সিপিএম— এই সঙ্কীর্ণ দলীয় সত্তা আমাদের মস্তিষ্ককে এমন ভাবে অধিকার করে রেখেছে, আমরা তার ঊর্ধ্বে উঠে সংবিধানের মৌল সত্তাকে স্পর্শই করতে পারছি না। আমরা আসলে এখন সংসদেও বিতর্কে মেতে উঠি সংসদের বাইরে ভোট রাজনীতির অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে।

ঐকমত্য শব্দটি ২০১৫ সালে বোধহয় সোনার পাথরবাটি। সনিয়া গাঁধী বলছেন, বাবাসাহেব কংগ্রেস নেতা ছিলেন। আর অম্বেডকরের রচনায় কী ভাবে নেহরু এবং গাঁধীকে আক্রমণ করা হয়েছে, সেগুলো পড়লে কংগ্রেসে থেকেও তিনি কতটা কংগ্রেসের কোন মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তা নিয়ে আরও বিতর্কের সামনে এসে আমাদের দাঁড়াতে হবে।

নিম্নবর্গ এবং দলিত সমাজের ক্ষমতায়ন চেয়েছিলেন বাবাসাহেব। কিন্তু তিনি নিজেই হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করেছেন, তা দেখে বিজেপি নেতাদের ভিরমি খেতে হবে। হিন্দু ধর্মের যুক্তির অভাব ছিল বলেই তিনি বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বলে স্বীকারোক্তি করে গিয়েছেন। বুদ্ধের শূন্যবাদ আর মার্কসের সাম্যবাদ তাঁকে নানা ভাবে প্রভাবিত করে। সমস্যা হচ্ছে, আমরা সবাই ইতিহাসের এই চরিত্রগুলিকে আমাদের আজকের দলীয় কর্মসূচিতে যুক্ত করতে চাইছি।

বিচ্ছিন্ন উদ্ধৃতি সংগ্রহ করে এক মনীষীকে নিজের দলের নেতা বলে প্রমাণ করাটা পুরনো অভ্যাস। যেমন, সিপিএম রবীন্দ্রনাথের মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ, এই উদ্ধৃতি ব্যবহার করে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে ইংরেজি ভাষায় শেখাটাই তুলে দিয়েছে। যেন রবীন্দ্রনাথ ঘোরতর ইংরেজি বিরোধী ছিলেন। সিপিএম আইনস্টাইনকেও আংশিক ভাবে গ্রহণ করে তাঁকে সমাজতন্ত্রী সাজিয়েছেন। কিন্তু তিনি যে স্পিনোজার ইশ্বরে বিশ্বাস করেন, আইনস্টাইনের সেই উদ্ধৃতি কিন্তু আমাদের মনে করিয়ে দেয়নি।

অম্বেডকরের বিতর্কের পর শুরু হয়েছে সহিষ্ণুতা ও অসহিষ্ণুতার বিতর্ক। রাজনাথ সিংহ এই সরকারকে হিন্দু শাসক বলেছেন কি বলেননি, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে মহম্মদ সেলিমের সঙ্গে। অনেক সময় অনেক ক্ষুদ্র বিষয় গুরুত্ব পেলে বিতর্কের বৃহৎ চিত্রটি বিনষ্ট হয়ে যায়। যেখানে রাজনৈতিক নেতারা অম্বেডকর কংগ্রেসের না বিজেপির না সিপিএমের তা নিয়ে মারামারি করেন, সেখানে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা নিয়ে মূল বিতর্কটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। ইতিহাসকে দলীয় স্বার্থের স্ফটিক দিয়ে না দেখে তাঁকে নির্মোহ ভাবে বৃহৎ প্রেক্ষাপট থেকে দেখার সহিষ্ণুতাটি আগে অর্জন করা প্রয়োজন।

মুসলিম এক ধর্মীয় নেতা বলেছেন, পুরুষ এবং নারী কখনওই সমান হতে পারে না। ইসলাম এই অসাম্যকে স্বাভাবিক ঘটনা বলেই বর্ণনা করেছে। সেটার সমালোচনা করতে গেলে কি মুসলিম ভোট হারানোর ভয় থাকে? এই বিতর্কটি তো কোনও ধর্মীয় বিতর্কই নয়। বিতর্কটি লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে। আবার, বিজেপি নেতারা আমির খানকে পাকিস্তানে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। সেটাও কি রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার পরিচয়? আর সবচেয়ে বড় কথা, এটাই কি আজ আমাদের অগ্রাধিকার? মহারাষ্ট্রের আহমদনগরের শনি মন্দিরে মহিলার প্রবেশ বর্জিত। সেখানে এক মহিলা প্রবেশ করেছিলেন বলে সেখানে শুদ্ধিকরণ করতে হয়েছে।

এই ঘটনার প্রতিবাদ জানানো মানে কিন্তু হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো নয়। সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভারতের রাজনীতির এটাই অগ্রাধিকার। সংবাদমাধ্যমের এটাই অগ্রাধিকার। এই সব খবরেরই না কি টিআরপি সব থেকে বেশি। আর টিআরপি বেশি, কারণ মানুষ না কি এগুলিই সব থেকে বেশি দেখতে চান। তা হলে আর যমুনা নদীর সংস্কার করে দরকার কী? গঙ্গা সংস্কারেরই বা কী দরকার? স্মার্ট সিটি তৈরিরও বা প্রয়োজন কী? মোবাইল ফোনের কল ড্রপের সমস্যা ঘোচানোরই বা কী প্রয়োজন?

আসুন, আমরা হিন্দু না মুসলমান, ব্রাহ্মণ না দলিত, অম্বেডকর বিজেপি না কংগ্রেস— এই সব বিতর্ক নিয়ে টেলিভিশনে বিতর্ক দেখি। এবং তার পরে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE