সংসদের বাদল অধিবেশনের প্রথম দিনেই স্পষ্ট হয়ে গেল কাজের কাজ কিছুই হবে না। সুষমা স্বরাজ আর বসুন্ধরা রাজের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে একটা তুলকালাম কাণ্ড চলবে। বিরোধী দল হিসাবে কংগ্রেস-বাম এবং প্রতিপক্ষ এমন সুযোগ ছাড়বেই বা কেন? নরেন্দ্র মোদীর সবে এক বছর হয়েছে। ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি। আর বলেছিলেন, ভ্রষ্টাচার-মুক্ত ভারত উপহার দেবেন। এক বছরের মাথাতেই ললিত মোদীর বোমা বিস্ফোরণ অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। নরেন্দ্র মোদী এখনও পর্যন্ত এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি। চলছে কৌশল এবং পাল্টা রণকৌশল। টু জি কেলেঙ্কারি, কমনওযেলথ কেলেঙ্কারি, মনমোহন সিংহের জমানায় ছিল কার্যত কেলেঙ্কারির মণিহারি দোকান। সেই কংগ্রেস আজ যদি বিজেপি-র বিরুদ্ধে কালিমা লেপন করতে পারে— সেটাই তো উচিত কাজ!
অন্য দিকে, প্রধানমন্ত্রী নিজে সরাসরি ললিত মোদীর কেলেঙ্কারিতে যুক্ত না হলেও তিনি অভিযুক্ত দু’জনকেই ইস্তফা দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন না। তার কারণ হল, বিজেপি-র ভয় তাতে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে। আজ যদি সুষমা-বসুন্ধরা ইস্তফা দেন তবে কি কাল থেকে কংগ্রেস ভাল ছেলে হয়ে যাবে? সংসদ চলতে দেবে?
কংগ্রেস শিবিরের বক্তব্য, একেবারেই তা নয়। বরং ধাপে ধাপে সুর চড়াবে দল। প্রথমে সুষমা। তার পরে একে একে নিশানায় আসবে বসুন্ধরা, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের মতো নেতারা। একসঙ্গে সব নেতার বিরুদ্ধে সুর চড়ানোর পরিবর্তে এক এক করে নিশানায় আনা হবে বিজেপি নেতাদের। যাতে গোটা অধিবেশন জুড়ে শাসক দলকে অস্বস্তিতে ফেলা সম্ভব হয়।
বিষয়টি বুঝতে পারছে বিজেপি-ও। সকালে বিজেপি সাংসদ দিলীপ সিংহ ভুরিয়ার মৃত্যুতে লোকসভা মুলতুবি হয়ে যায়। কিন্তু রাজ্যসভা শুরু হতে না হতেই বিরোধীরা সুষমার প্রশ্নে সরব হয়। কংগ্রেসের রাজ্যসভার দলনেতা আনন্দ শর্মা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা দাবি করেন। এক কথায় রাজি হয়ে যায় বিজেপি। কংগ্রেসের দাবি মেনে ২৬৭ ধারায় আলোচনা মেনে নেয়, তা জেটলির কৌশলী পদক্ষেপ বলেই মনে করছে রাজনৈতিক শিবির। জেটলির চালে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যাওয়া কংগ্রেস তখন পাল্টা কৌশলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার শেষে ভোটাভুটি দাবি করে। যা মানতে চায়নি শাসক শিবির। দাবি-পাল্টা দাবির মধ্যেই বারংবার মুলতুবি হয়ে যায় রাজ্যসভার অধিবেশন।
আগামিকাল ফের বিষয়টি নিয়ে উভয় কক্ষেই সরব হওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে কংগ্রেস শিবির। অরুণ জেটলি বলেন, ‘‘কংগ্রেস ও বাম আসলে আলোচনা চাইছে না। রাজ্যসভায় আলোচনার দাবি উঠেছিল। আমরা তা মেনে নিয়েছিলাম। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও সংসদের কাছে জবাব দিতে প্রস্তুত। বিরোধীরা যে ভোটাভুটির দাবি তুলেছে তা আসলে সভা পণ্ড করার উদ্দেশ্যেই করা হচ্ছে। মূল লক্ষ্যটি আলোচনা নয়, তা হল সংসদকে অচল করে দেওয়া।’’ বিজেপি ওই দাবি করলেও সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ‘‘টুজি কেলেঙ্কারির সময়ে ওই বিজেপি জেপিসি-র দাবিতে সরব ছিল। কংগ্রেস তাতে রাজি না হওয়ায় সে সময়ে সংসদের কাজ ভণ্ডুল করে দিয়েছিল তারা। এখন সেই বিজেপি-কে ভোল পাল্টালে হবে কী করে!’’
বিজেপি সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রী না সুষমা স্বরাজের ইস্তফা দেওয়ার পক্ষে, না তিনি বসুন্ধরাকে ইস্তফা দিতে বলেছেন। আজ যদি বসুন্ধরা-সুষমা ইস্তফা দেন তবে কি কাল থেকে কংগ্রেস সংসদ চলতে দেবে? গত বারের বাজেট অধিবেশনের সময়ে দুর্নীতির ইস্যু ছিল না। তা-ও বিরোধীদের ঝামেলায় অধিবেশন চালাতে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল সরকারকে। তা ছাড়া বিজেপি শিবির মনে করছে, ওই দু’জনকে ইস্তফা দিতে বললেও বিল নিয়ে আলোচনা কংগ্রেস শুরু করতে দেবে এমন নয়। বরং রক্তের স্বাদ পাবে বিরোধীরা। তখন মধ্যপ্রদেশ-মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীদের পাশাপাশি বেশ কিছু কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে নিশানা করবে বিরোধীরা। এর পর কংগ্রেস-বাম সমবেত ভাবে দাবি তুলবে, প্রধানমন্ত্রীকে ইস্তফা দিতে হবে। প্রশ্ন তুলবে, এমন দুর্নীতি হল কেন? সুতরাং শুরু হল স্নায়ুর যুদ্ধ। কে আগে নতি স্বীকার করে সেটাই এখন দেখার। বিরোধী দল আরও আক্রমণাত্মক হবে। আর সরকার কি পিছু হঠবে?
সমাজতাত্ত্বিক আন্দ্রে বেতে একটা শব্দ ব্যবহার করেছিলেন— ‘পলিটিক্যাল সিমবায়োসিস’। তিনি বলেছিলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে এই রাজনৈতিক মিথোজীবীতা খুব প্রয়োজন। কারণ দেশ চালাতে গেলে সমাজের কল্যাণ করতে গেলে, নীতি রূপায়ণ করতে গেলে প্রয়োজন শাসক এবং বিরোধী দলের সমন্বয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমাদের দেশে সংসদ আর জনসভায় কোনও ফারাক নেই। অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন তিনি যখন বিলগ্নিকরণের কথা বলেছিলেন, তখন বিরোধিতা করেছিল কংগ্রেস। আবার যখন কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে তখন একই ভাবে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছিল বিজেপি। আজ আবার সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। প্রশ্ন হচ্ছে, সংসদটা কি তা হলে নির্বাচনী রাজনীতির একটা কর্মশালা? দেশ শাসনের জন্য নীতি আইন প্রণয়নের জন্য কি সংসদ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাচ্ছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy