নরেন্দ্র মোদী ও রাহুল গাঁধী।— ফাইল চিত্র।
রাহুল গাঁধীকে অমেঠী যেতে বাধা দিয়েছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার। এ-ও এক বিচিত্র রাজনৈতিক পরিস্থিতি। রাহুল গাঁধী এক গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী নেতা। তিনি তাঁর নির্বাচিত কেন্দ্রে যাবেন, তাতে কার কী বলার থাকতে পারে? জেলাশাসক জানালেন, নিরাপত্তার কারণে তাঁর এখন অমেঠী যাওয়া অনুচিত। তারপর বিজেপি সূত্র জানাল, ১০ সেপ্টেম্বর অমিত শাহ যাবেন অমেঠী। তার আগে নাকি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্ব জানান যে, রাহুল গাঁধী এত দিন যাননি, এখন অমিত শাহ যাচ্ছেন শুনেই তিনি যেতে চাইছেন। অতএব, তাঁর যাত্রাকে বানচাল করতে হবে। অমেঠীর নানা স্থানে তত দিনে পোস্টার লাগানো হয়েছে, গত তিন বছরে কেন রাহুল গাঁধী এখানে আসেননি? বিজেপি-ই এই পোস্টারগুলি লাগায় অমিত শাহের সফরের প্রাক্কালে। জেলাশাসক আসতে নিষেধ করলেও তা অবজ্ঞা করেন রাহুল। তিনি জানিয়ে দেন, নিষেধাজ্ঞা না মেনেই অমেঠী যাবেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ৪ অক্টোবর, বুধবার পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুসারেই অমেঠী গেলেন। রাজ্য সরকারও পিছিয়ে এসেছে রাহুলের কট্টর অবস্থান দেখে।
অবাক হয়ে যাচ্ছি! রাহুল গাঁধীকে নিয়ে বিজেপি সদাসর্বদা ঠাট্টামস্করা করে চলেছে। সর্বদাই বিজেপি নেতারা রাহুলকে রাজনৈতিক গুরুত্ব পর্যন্ত দিতেও রাজি নন। আমার প্রশ্ন যে, তা হলে কেন রাহুলের একটা ছোট্ট সফর বাতিল করার মরিয়া চেষ্টা? তা হলে কি আসলে বিজেপি রাহুলকে ভয় পাচ্ছে? এ ভাবে রাহুলের সফর বাতিল করার চেষ্টা আর যাই হোক, বিজেপি শিবিরের জন্য খুব শুভ সংবাদ নয়।
কেউ কেউ এ ঘটনার জন্য সরাসরি যোগী আদিত্যনাথকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। অনেকে বলছেন যোগী নিজেই এই সিদ্ধান্ত নেন। রাহুলকে আটকানোর জন্য বিজেপির এই পরিকল্পনা— আমি এই প্রচারিত তত্ত্বকে মানছি না। কারণ, আমার রাজনৈতিক উপলব্ধি হল, যে ভাবে রাহুলের নির্বাচনী কেন্দ্রে স্মৃতি ইরানি প্রথম দিন থেকে সক্রিয়, সেটি যোগী নয়, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরই রণকৌশল। কাজেই, এটাই বিজেপির রাজনৈতিক রণকৌশল যাতে রাহুল গাঁধীর বিষদাঁত তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রেই ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি বিপুল ভোটে জিতেছে। উত্তরপ্রদেশের লোকসভা আসনগুলির সিংহভাগ দখল করে তারা। তারপর উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে রাহুল-অখিলেশ সমঝোতা সত্ত্বেও বিজেপি অভূতপূর্ব ভাবে ভাল ফল প্রদর্শন করেছে। ভারতীয় রাজনীতি সম্পর্কে বলা হয়, যো জিতা ও হি সিকন্দর। এ হেন জয়লাভের পর রাহুলের নেতৃত্বে জোট গঠনের রণকৌশল নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নোট স্থগিতের সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব মানুষের উপর পড়েছে, বিরোধীদের তোলা অভিযোগটিও নস্যাৎ করে দেওয়া হয়।
অমেঠীতে জনসভায় রাহুল গাঁধী। — পিটিআই
কিন্তু জাতীয় স্তরে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধ্যানধারণায় আবার বদল এসেছে। দেশের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধির নিম্নমুখী প্রবণতা। নানা অর্থনীতিবিদের তীব্র সমালোচনা। এমনকী, মোদীর আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহা যে ভাবে আক্রমণ হেনেছেন তাতেও সরকারের অস্বস্তি বেড়েছে। অরুণ শৌরি এবং বিরোধী নেতা, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমও সোচ্চার। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, তবে জিএসটি-র মতো আর্থিক সংস্কার, নোট বাতিলের মতো সিদ্ধান্তের ফলে আসলে কি অর্থনীতিতে কুপ্রভাবই পড়েছে যা উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে বোঝা যায়নি?
প্রেক্ষাপট বদলাচ্ছে। দিল্লির শাসনের তিন বছর অতিবাহিত হওয়ার পর একটা বিকল্প রাজনৈতিক পরিসর তৈরি হচ্ছে। অসন্তোষ মানুষের বাড়ে, কমে না। যেমন, মূল্যবৃদ্ধি। দাম কমার কথা শুনেছেন কখনও? সব সময় আমরা তো দাম বাড়ার কথাই শুনি। এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই রাহুল গাঁধীর প্রাসঙ্গিকতাও বাড়ছে। একেই বলে ল অব নেচার। প্রকৃতির নিয়ম। একটা কুল ভাঙলে অন্য কুল গড়ে। রাহুলও ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন এই মোহভঙ্গকে মূলধন করে। একদিন যেমন মনমোহন সিংহ সরকারের বিরুদ্ধে নীতিপঙ্গুতা ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, ঠিক সে ভাবেই এই সরকারের রাজনৈতিক ব্যর্থতা নিয়েও আজ প্রশ্ন উঠছে।
রাহুলও উঠে আসছেন এক নতুন অবয়ব নিয়ে। আমি বলছি না, পাশা উল্টে গেছে। এখনও নরেন্দ্র মোদীর প্রতি দেশের এক বিপুল জনসমাজের অটুট বিশ্বাস। কোটি কোটি মানুষ মনে করেন, মোদীই পারেন এ দেশের ভাল করতে। মোদীই পারেন খোলনলচে বদলে দিতে। এই ভক্তিতে হয়তো কিঞ্চিৎ চিড় ধরতে শুরু করেছে। কারণ, বুন্দেলখণ্ড থেকে খবর আসছে কৃষকদের আত্মহত্যার। দেশে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। উল্টে বেকারি বাড়ছে। বিদেশি লগ্নি বাড়ছে না। মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে, রূপকথা আর বাস্তব এক নয়। এই অনাস্থা প্রক্রিয়াটিও তাই ধীর লয়ে শুরু হয়েছে।
আর তাই রাহুল সক্রিয় হতে না হতেই বিজেপি রাহুল-বিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy