Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বিবিধ কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা থাকতেই হবে

জেএনইউয়ের ঘটনার পরে সেই দাবিই জোরালো হচ্ছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল রাজধানী শহরে ক’দিন আগে এসেছিলেন অর্মত্য সেন। ঠিক যে সময়ে জহওরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিতর্ক চরমে, ঠিক সে সময়ে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে এডিটরস গিল্ডের আমন্ত্রণে এসে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বিরোধী মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে এক অসাধারণ বক্তৃতা দিলেন।

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:১৫
Share: Save:

রাজধানী শহরে ক’দিন আগে এসেছিলেন অর্মত্য সেন। ঠিক যে সময়ে জহওরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিতর্ক চরমে, ঠিক সে সময়ে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে এডিটরস গিল্ডের আমন্ত্রণে এসে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বিরোধী মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে এক অসাধারণ বক্তৃতা দিলেন। সে দিন ওঁর বক্তব্যের মূল সুর ছিল পরমত সহিষ্ণুতা। ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহুত্ববাদের। সম্রাট অশোক থেকে আকবর, সেই পরম্পরা মেনে চলেছে তর্কপ্রিয় ভারতীয়। একটা মানুষের অনেকগুলি পরিচিতি বা আইডেন্টিটি থাকে। আবার একটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে আর এক সম্প্রদায়ের, একটি সমাজের সঙ্গে আর এক সমাজের এই পরিচিতির ভিন্নতা সহাবস্থান করে। অমর্ত্য আক্ষেপের সুরে বললেন, অসহিষ্ণুতা সম্পর্কে আমরা বোধহয় বড় বেশি সহিষ্ণু হয়ে পড়েছি। আসলে ক্ষমতার ঔদ্ধত্য গণতন্ত্রের মৌল ভাবনাতেই কুঠারাঘাত করে।

চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্দেরা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার উপর রুশ আগ্রাসনের বিরোধিতায় করায় ১৯৭০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে বহিষ্কার করে। চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। সমস্ত রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারে কুন্দেরা-র বই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে ১৯৫০ সালে দলবিরোধী মতপ্রকাশের জন্য তাঁকে বহিষ্কার করা হলেও ১৯৫৬ সালে তাঁকে আবার দলে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। ’৭০-এর বহিষ্কারের পর তিনি প্যারিসে চলে আসেন। এবং পরবর্তীকালে ফরাসি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। মিলান কুন্দেরা একটি ছোট্ট দৃষ্টান্ত। দস্তয়ভস্কি থেকে শুরু করে অস্কার ওয়াইল্ড, আরও অতীতে পৌঁছলে সক্রেটিসের বিষ পান, ঐতিহাসিক জবানবন্দি— এ সবই অন্ধ ক্ষমতার প্রদর্শন আর মতপ্রকাশের অধিকারের উপর চাবুকের আঘাত।

অমর্ত্য সেন সে দিন এ কথাও বলেন যে, দিল্লির মসনদে এই সরকার বসার পরেই যে অসহিষ্ণুতা শুরু হয়েছে তা তো নয়। সলমন রুশদির বই নিষিদ্ধ করা থেকে শুরু করে মকবুল ফিদা হুসেনের দেশত্যাগ— এ সব তো অসহিষ্ণুতার পরিচয় বহন করে। ট্রটস্কি থেকে ডক্টর জিভাগো, এ এক লম্বা তালিকা। অমর্ত্যকে প্রশ্ন করেছিলাম, তর্কপ্রিয় ভারতীয় তর্ক তো করবেই। সেই তর্কের বিরোধ থেকে সমন্বয়সাধন করাটাই লক্ষ্য। তাই প্রয়োজন কথোপকথনের প্রক্রিয়া। আবার একটা পরিচিতির সঙ্গে অন্য আর একটি পরিচিতি হিংসার জন্ম দেয়, তখন সমন্বয়সাধন সম্ভব হয় না। তা হলে লক্ষণরেখাটি কোথায়? আমরা কত দূর পর্যন্ত তর্ক করতে পারি? কার সঙ্গে তর্ক হতে পারে? যে শাসক গোষ্ঠীর নীতি ও ন্যায্যতার মানসিকতাই নেই তার সঙ্গে কথোপকথন কী ভাবে সম্ভব? অমর্ত্য সেনের জবাব, এ বিষয়ে কোনও লক্ষণরেখা নেই। শুধু ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। এই মানসিকতা বৃদ্ধির প্রচার চালানো প্রয়োজন। এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের দায়বদ্ধতা রয়েছে। এই পরমতসহিষ্ণুতা থাকলে শ্রীচৈতন্যের উপরেও আঘাত আসত না। কিছু উগ্র গোঁড়া ব্রাহ্মণ, সদ্য গেরুয়াধারী স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর ভ্রাতা সন্ন্যাসীদের উপর ঢিল ছুড়ে মারত না।

কৌটিল্য বলেছিলেন, প্রজার সুখেই রাজার সুখ। তাদের কল্যাণেই রাজার কল্যাণ। যেটি রাজাকে খুশি করে সেটিকেই রাষ্ট্রহিতকর, শুভ এবং মঙ্গল হিসাবে গ্রহণ করবেন না, বদলে যা তাঁর প্রজাদের খুশি করবে, সেটিতেই তিনি খুশি হবেন ও উপকৃত বলে মনে করবেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখন ক্ষমতার আসনে। তিনি সমস্ত ভারতবাসীর প্রধানমন্ত্রী। তিনি কেবল মোহন ভাগবতের প্রধানমন্ত্রী নন। তিনি শুধু অমিত শাহের প্রধানমন্ত্রী নন। হায়দরাবাদ বা জেএনইউয়ের ঘটনায় কে দোষী আর কে দোষী নয়, তার চুলচেরা বিচার এখানে লক্ষ্য নয়। কিন্তু গোটা দেশে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির উপর আঘাত আসছে, এই সৃষ্ট ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করাটাও শাসকের দায়িত্ব। প্রতিবাদ বিক্ষোভ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অঙ্গ। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হল গণতান্ত্রিক দেশে শাসক ও বিরোধীদের সমন্বয়সাধন করা। সমাজতাত্ত্বিক আন্দ্রে বেঁতেই বলেছেন, প্রয়োজন রাজনৈতিক মিথোজীবীতা (সিমবায়োসিস)। এই মিথোজীবীতাই সংসদীয় গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। বিবিধের মাঝে মহান মিলন বাস্তবায়িত করতে পারে। ভারত উত্তর কোরিয়া নয়। এমনকী, চিনও নয়। ভারতের মতো একটি বিশাল দেশে যদি বিবিধ কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা না থাকে তা হলেই বিপদ। জাতীয়তাবাদ আসলে উপ-জাতীয়তাবাদ তথা আঞ্চলিকতাবাদের বিপরীত শব্দ নয়। আসলে একটি অন্যটির পরিপূরক। ঠিক যেমন ভাবে নানা ধরনের জাতপাতের অস্তিত্ব অখণ্ড ভারতীয় ব্যবস্থারই একটি অনিবার্য অঙ্গ। সংঘাত আছে। সংগ্রাম আছে। স্থিতাবস্থা ভাঙার চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু এই সব বিভিন্নতার মধ্যে দশকের পর দশক ভারত টিকেও আছে। সেই অখণ্ড ভারতকে কোনও রকম অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলা আমাদের কর্তব্য নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE