নেশা: এই দৃশ্য হামেশাই দেখা যায় গ্রামীণ এলাকায়। নেটওয়ার্কের সমস্যা থাকলে গাছে চড়ে এক মনে গেম খেলে কিশোরেরা। ছবি: সুশান্ত সরকার।
করোনা-কালে অনলাইন গেমে আসক্তি বাড়ছে শিশুদের। ‘নিও নর্মাল’ জীবনে এই সমস্যা শহরের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়াচ্ছে গ্রামেও। এমনটাই জানাচ্ছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর ও ডায়মন্ড হারবার চাইল্ড লাইন। অনলাইন গেম থেকে কচিকাঁচাদের দূরে সরিয়ে রাখার নানা উপায় বাতলাচ্ছেন শিশুদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা।
মাস দুয়েক আগের কথা। ভোরবেলা ঘর ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল মগরাহাটের বছর বারোর এক বালক। বাবা-মা উঠে পড়ায় ধরা পড়ে যায় সে। ছেলের আচরণে স্তম্ভিত দম্পতি যোগাযোগ করেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা চাইল্ড লাইনের সঙ্গে। চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর (ডায়মন্ড হারবার) দেবারতি সরকার বলেন, ‘‘কাউন্সেলিংয়ের সময় ওই বালক জানায়, অনলাইনে ‘ফ্রি ফায়ার’ খেলতে মায়ের কাছে মোবাইল চেয়েছিল সে। তা না মেলায় ঘর থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিল। ওর ইচ্ছা ছিল দিল্লি যাওয়ার। সেখানে টাকা রোজগার করে মোবাইল কেনার পরিকল্পনা করেছিল। এখনও ওই শিশুর কাউন্সেলিং চলছে।’’
গত ফেব্রুয়ারির ঘটনা। ডায়মন্ড হারবারের এক বাসিন্দা তাঁর কিশোর ছেলের হাতে মোবাইল দিতে চাননি। তার পরে ওই কিশোর তার বাবার অফিসের গুরুত্বপূর্ণ নথি লুকিয়ে রেখেছিল কয়েক সপ্তাহ। ফলে, অফিসে নানা সমস্যায় পড়েছিলেন তার বাবা। ওই শিশুরও কাউন্সেলিং করেছেন দেবারতিরা। ওই বালক তাঁদের জানায়, বাবাকে শাস্তি দিতেই সে ওই
কাজ করেছিল।
চাইল্ড লাইন সূত্রে খবর, এই ধরনের ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। অনলাইন গেমের প্রতি ছেলেমেয়ের আসক্তি ছাড়াতে বহু দম্পতি যোগাযোগ করছেন তাদের সঙ্গে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামীণ এলাকায় এই সমস্যা শহরের তুলনায় ছড়াচ্ছে বেশি। তিনি জানান, প্রত্যেক মাসে ৭-১০ জন দম্পতি তাঁদের ছেলেমেয়ের কাউন্সেলিংয়ের জন্য নিয়ে আসছেন। দেবারতি বলেন, ‘‘ফোন না পেয়ে মেজাজ হারিয়ে অনেক শিশুই বই-খাতা বা অন্য জিনিস ছুড়ে ফেলছে। অভিভাবকদের উচিত, এমন ঘটনা ঘটলে, ছেলেমেয়েদের মারধর না করে তাদের কাউন্সেলিং করানো। না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।’’ তিনি বলেন, ‘‘গত বছর লকডাউনের পরে শহরাঞ্চলে এই সমস্যা দেখা গিয়েছিল। এখন গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে।’’ বারুইপুর চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর অভিজিৎ বসু বলেন, ‘‘আমাদের কাছেও অনেক অভিভাবক তাঁদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসেন। সেই সব শিশু অনলাইন গেমে আসক্ত। শিশুদের কাউন্সেলিং করাই টেলি-কনফারেন্স-এর মাধ্যমে। তবে কাউন্সেলরদের থেকে বাবা-মায়ের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের আগে সচেতন হতে হবে।’’ সমস্যা থেকে বেরনোর উপায় কী?
অভিজিতের কথায়, ‘‘লক্ষ্য রাখতে হবে, ছেলেমেয়ে এমন গেম যাতে না খেলে, যা তাদের মনের জগতে হিংসার উদ্রেক করে। এমন কোনও গেম খেলতে দেওয়া উচিত নয়, যাতে বন্দুকের ব্যবহার বা অর্থ উপার্জনের হাতছানি রয়েছে। অভিভাবকদের বলি, আপনারাই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অনলাইনে লুডো, ক্যারম এবং ওই জাতীয় গেম খেলুন। ছেলেমেয়ের হাতে মোবাইল ফোন দেওয়ার পরে নজর রাখুন, তারা কী গেম খেলছে।’’ দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে শিশুদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছেন মঞ্জির ঘোষ। গবেষণার মাধ্যমে করোনা-কালে শিশুদের একাকীত্ব থেকে মুক্ত রাখার নানা পন্থা বার করেন তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা। শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত মঞ্জির বলেন, ‘‘মোবাইল এখন নিও নর্মাল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মোবাইল বাদ গিয়ে চলা যাবে না। এই অবস্থায় আগে ছেলেমেয়েদের মনের চাহিদা তার বাবা-মাকে বুঝতে হবে। অনলাইন গেম-এর প্রতি আসক্তি তৈরি হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’’ তাঁর মতে, ছেলেমেয়ে এবং তাঁদের বন্ধুবান্ধবদের একটি গ্রুপ তৈরি করে তাদের নাচ, গল্পলেখা, অভিনয় করা, ছবি আঁকার মতো কাজে যুক্ত করে দিলে অনলাইন গেমের প্রতি আকৃষ্ট হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy