বারুইপুরের পদ্মপুকুর এলাকায় একটি বেসরকারি অফিসে কাজ করেন নদিয়ার তরুণী সুতপা। অফিসের কাছেই মেসে ভাড়া থাকেন। সকালে অফিস যান। কাজ সেরে মেসে ফিরতে রাত ৮টা-৯নটা বেজে যায়। মঙ্গলবার সুতপার মেস মালিক ফোন করেন তাঁর অফিসে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। জানিয়ে দেন, আপাতত কয়েকটা দিন সন্ধের আগে যেন ছেড়ে দেওয়া হয় সুতপাকে। অঘটন কিছু ঘটে গেলে দায়ী থাকতে হবে অফিস কর্তৃপক্ষকেই। গত দু’দিন ধরে সুতপাকে অফিস থেকে সত্যিই তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
ওই অফিসের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘কাজের ক্ষতি হলেও কিছু করার নেই। নিরাপত্তার ব্যাপারে তো আর ঝুঁকি নেওয়া যায় না।’’
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এলাকার অন্যান্য মেসের মেয়েদের উপরেও সন্ধের পরে বাইরে না থাকার ফতোয়া জারি হয়েছে। স্কুল বা টিউশনে যাওয়া আসার ক্ষেত্রেও মেয়েদের একা ছাড়তে ভয় পাচ্ছেন বাবা-মা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়ির কেউ গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসছেন। ছুটি হলে নিয়েও আসছেন তাঁরা। বাড়তি সতর্ক থাকা হচ্ছে বাচ্চাদের ব্যাপারেও।
গোটাটাই সাম্প্রতিক গুজব কাণ্ডের জের। গত কয়েক দিন ধরে নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার নানা প্রান্তে। কখনও বলা হচ্ছে, এলাকায় ঢুকে পড়েছে কিডনি পাচারকারীর দল। বাড়িতে কাউকে একা পেলে পেট কেটে বের করে নিচ্ছে কিডনি। কোথাও বলা হচ্ছে, নারী এবং শিশুপাচারকারীরা জাল ছড়িয়েছে। যুবতী মেয়ে বা শিশুদের একা পেলেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারা।
মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায় এ সব প্রচারের জেরে আতঙ্কিত বহু মানুষ। বারুইপুর, দক্ষিণ বারাসত, বহড়ু, জয়নগর-সহ বহু জায়গায় একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে কাজ করছে এই আতঙ্ক। স্রেফ সন্দেহের বশে মারধর করা হয়েছে কাউকে কাউকে। মগরাহাটে দু’জনের মৃত্যুও হয়েছে গণপিটুনিতে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, মানসিক ভারসাম্যহীন বা ভবঘুরেরাই শিকার হচ্ছেন বেশি।
এই পরিস্থিতি বাইরে থেকে যাঁরা কাজে বা অন্য প্রয়োজনে আসেন দক্ষিণ ২৪ পরগনায়, তাঁরা আরও বেশি আতঙ্কিত। দক্ষিণ বারাসতের একটি মোটরবাইক শোরুমে কাজ করেন বারুইপুরের অয়ন। বছর উনিশের যুবক বেশ ঘাবড়ে আছেন। বললেন, ‘‘শুনছি নানা জায়গায় নানা ঘটনা ঘটছে। ট্রেনে আসার পথেও নানা কথা কানে আসছে। বেশ ভয়ে ভয়েই আছি। চেষ্টা করছি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাওয়ার।’’ মার্কেটিংয়ের কাজে প্রায়ই জয়নগরে আসেন গড়িয়ার অরিত্র। তিনি বলেন, ‘‘যা কানে আসছে, তাতে ভয় তো লাগছেই। এই ক’দিন এই দিকটা একটু এড়িয়ে অন্য দিকে কাজ করার চেষ্টা করছি। ব্যাপারটি থিতিয়ে গেলে না হয় আবার আসব।’’ তাঁদের নিয়েই না কেউ সন্দেহ করে বসেন, এই নিয়ে ভয়ে ভয়ে আছেন বাইরে থেকে কাজে আসা অনেকে।
জয়নগরের নিমপীঠে একটি জলপ্রকল্পের কাজে মিস্ত্রিরা অনেকেই অন্য জেলা থেকে এসেছেন। ভিনরাজ্যের কর্মীও আছেন। এলাকায় তাঁদের কেউ তেমন চেনে না। ফলে তাঁদের ভয় অন্য। ঝাড়খণ্ড থেকে আসা এক শ্রমিকের কথায়, ‘‘এখানে কেউ আমাদের চেনে না। ভাষাটাও ভাল বলতে পারি না। চার দিকে যা হচ্ছে, তাতে বাইরে বেরোতে একটু ভয় তো হচ্ছেই। কাজ না থাকলেও প্রোজেক্ট এরিয়ার ভিতরেই থাকার চেষ্টা করি।’’
এলাকার অনেকে জানান, বাইরে থেকে যে সমস্ত ফেরিওয়ালা পাড়ায় পাড়ায় ঘোরেন, গত কয়েক দিনে তাঁদের আসা-যাওয়াও কম। পুলিশের তরফে গুজবের বিরুদ্ধে প্রচার চলছে। পুলিশ জানাচ্ছে, ছেলে চুরি বা এ রকম ঘটনার অভিযোগ গত কয়েক দিনে জমাই পড়েনি। মানুষকে অহেতুক আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য বিভিন্ন ভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে পুলিশ-প্রশাসনের তরফে। পাশাপাশি অচেনা কাউকে দেখে সন্দেহ হলে আইনি নিজের হাতে তুলে না নিতে অনুরোধ করা হচ্ছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে গুজবের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। যারা বাইরে থেকে কাজে আসছেন তাঁদেরকেও নির্ভয়ে কাজ করতে বলেছে পুলিশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy