Advertisement
০৮ মে ২০২৪
কোথাও বদল, কোথাও অটল

ঘরের কোন্দলে রাশ টানতে চায় তৃণমূল

এলাকায় উন্নয়ন হয়েছে বিস্তর। কিন্তু বন্ধ হয়নি খুনখারাপি। তৃণমূলের অন্দরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে। গত কয়েক মাসের মধ্যে দু’দুবার ওসি বদল হয়েছে। দলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক রীতিমতো অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন এলাকার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে। এই পরিস্থিতিতেই এ বার উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া বিধানসভা কেন্দ্রে গতবারের জয়ী প্রার্থী বদলের সিদ্ধান্ত নিল তৃণমূল। গতবারের জয়ী জুলফিকার আলি মোল্লাকে সরিয়ে এই কেন্দ্রে আনা হল নুরুল ইসলামকে।

গেলেন, জুলফিকার আলি মোল্লা। এলেন, নুরুল ইসলাম।

গেলেন, জুলফিকার আলি মোল্লা। এলেন, নুরুল ইসলাম।

নির্মল বসু ও অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
হাড়োয়া ও দেগঙ্গা শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৬ ০১:৪৯
Share: Save:

এলাকায় উন্নয়ন হয়েছে বিস্তর। কিন্তু বন্ধ হয়নি খুনখারাপি। তৃণমূলের অন্দরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে।

গত কয়েক মাসের মধ্যে দু’দুবার ওসি বদল হয়েছে।

দলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক রীতিমতো অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন এলাকার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে।

এই পরিস্থিতিতেই এ বার উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া বিধানসভা কেন্দ্রে গতবারের জয়ী প্রার্থী বদলের সিদ্ধান্ত নিল তৃণমূল। গতবারের জয়ী জুলফিকার আলি মোল্লাকে সরিয়ে এই কেন্দ্রে আনা হল নুরুল ইসলামকে। সেই নুরুল, যিনি বসিরহাটের সাংসদ ছিলেন ২০১১ সালে। নানা বিতর্কের মুখ হয়ে ওঠায় যাঁকে ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর আসনে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন দলনেত্রী। যদিও সে বার জিততে পারেননি নুরুল। এ বার ফের ভোটের ময়দানে তিনি।

এক সময়ে সিপিএমের ‘শক্ত ঘাঁটি’ হাড়োয়ায় ২০১১ সালে জোটপ্রার্থী হিসাবে ১১৬৫ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন জুলফিকার। হারিয়েছিলেন সিপিএম প্রার্থী ইমতিয়াজ হোসেনকে। এলাকার প্রবীণ ব্যবসায়ী মানুষটি ‘সজ্জন’ এবং ‘প্রচারবিমুখ’ বলেই পরিচিত। তাঁর আমলে গত পাঁচ বছরে বিস্তর উন্নয়নের সাক্ষী থেকেছে হাড়োয়া। রাস্তাঘাট, পানীয় জল, আলো— উন্নয়ন রীতিমতো চোখে পড়ে এই সব ক্ষেত্রে।

কিন্তু তারপরেও কেন কোপ পড়ল জুলফিকারের উপরে?

তার কারণ খুঁজতে গেলে বুঝতে হবে হাড়োয়ার আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত। প্রায় ৭০-৮০ হাজার বিঘা মাছের ভেড়ি আছে হাড়োয়া। বারাসত ২ ব্লকের শাসন, দেগঙ্গার কিছু অংশও পড়ে হাড়োয়া বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে। এক সময়ে রাজ্যে সব থেকে বেশি ব্যবধানে জয়ী হতেন হাড়োয়ার সিপিএম প্রার্থী। সেই সঙ্গে চলত ভেড়ির টাকার বখরা নিয়ে খুনখারাপি, বোমাবাজি, খুনোখুনি।

প্রার্থিতালিকা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়াল লিখতে নেমে পড়লেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা।
শুক্রবার বনগাঁয় নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।

গতবার বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলের প্রচারের প্রধান অংশ জুড়ে ছিল, হাড়োয়ায় দরিদ্র মানুষকে জলকরের (মেছোভেড়ি) লভ্যাংশ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে নাগরিক পরিষেবায় উন্নয়ন চোখে পড়লেও হিংসার রাজনীতিতে রাশ টানা যায়নি। ভেড়ি এলাকার জটিল রাজনৈতিক আবর্তকে যে শক্ত হাতে মোকাবিলার দরকার ছিল, জুলফিকার সে দিক থেকে উপযুক্ত ছিলেন না, মনে করেন তৃণমূলের একাংশই। ফলে গত কয়েক বছরে হাড়োয়ায় মেছোভেড়ির বখরা নিয়ে বোমা-গুলির লড়াই থামেনি। বরং শাসক দলেরই নানা গোষ্ঠী, উপগোষ্ঠী দাপিয়ে বেড়িয়েছে এলাকায়। যাদের দাপটে গরিব মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে। আর্থিক হালও ফেরেনি। হাড়োয়ার মানুষ জনান্তিকে বলেন, ‘‘যে দলই জয়ী হোক না কেন, হাড়োয়ার মানুষের শান্তি নেই। মেছোভেড়ির টাকা নিয়ে বিবাদকে কেন্দ্র করে শাসক দলেরই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার এখানকার বহু মানুষ।

পরিসংখ্যানও বলছে সে কথা। পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে সিপিএমের ১ জন এবং তৃণমূলের ৪ জন কর্মী খুন হয়েছেন। অনেক মানুষ এখনও ঘরছাড়া। একাধিক অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

হাড়োয়ায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে রাশ টানতে এই আসনে বাইরের প্রার্থী চাইছিলেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশ।

জুলফিকারের বড় ছেলে জাহাঙ্গির ক’দিন আগেই বলছিলেন, ‘‘বাবা হাড়োয়ার মানুষের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে বিধায়ক কোটার ৩ কোটি টাকা খরচ করেছেন। এ ছাড়াও, রাজ্য সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রকল্প বাবদ আরও দু’শো কোটি টাকা হাড়োয়ার উন্নতিতে খরচ করা হয়েছে।’’ সে কথা অস্বীকার করছেন না স্থানীয় মানুষও। কিন্তু তারপরেও তৃণমূলের প্রার্থী বদল হল এই কেন্দ্রে। কী বলছেন জুলফিকার নিজে?

দলের প্রার্থিপদ প্রকাশের পরে যোগাযোগ করা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। ভাবলেশহীন হয়ে টেলিফোনের ও পার থেকে বললেন, ‘‘দল যা করেছে, ভালই করেছে। যিনি প্রার্থী, তাঁকে জয়ী করার জন্য এখন থেকে খাটব।’’

কিন্তু গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জীর্ণ হাড়োয়ায় তা কতটা সম্ভব, জানতে গেলে অপেক্ষা করতে হবে ভোটের ফল প্রকাশ পর্যন্ত।

ইতিমধ্যে প্রার্থী হয়ে নিজের উচ্ছ্বাস চেপে রাখছেন না নুরুল ইসলাম। খবর পেয়েই হাড়োয়ায় চলে যান তিনি। সেখান থেকে টেলিফোনে বললেন, ‘‘হাড়োয়া আমার পুরোন এলাকা। সবাই খুব খুশি। আমি দলের অনুগত সৈনিক। দল যা দায়িত্ব দিয়েছে, তা পালন করব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’’

দেগঙ্গায় এত দিন বিধায়ক ছিলেন চিকিৎসক নুরুজ্জমান। এ বার তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হুগলির পুড়শুড়ায়। সেখানে তৃণমূলের পারভেজ রহমানকে সরিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে তাঁকে।

কিন্তু কেন পুরনো এলাকা থেকে সরানো হল নুরুজ্জমানকে?

দেগঙ্গার ভূমিপুত্র নন তিনি। এলাকায় নিয়মিত যাতায়াত করেন না বলেও দলের অন্দরেই ক্ষোভ ছিল তাঁকে নিয়ে। ফলে তাঁর বিরুদ্ধ গোষ্ঠী ক্রমেই সক্রিয় হয়ে উঠছিল। বিষয়টি এমন জায়গায় পৌঁছয়, দ্বন্দ্ব মেটাতে দু’পক্ষকে নিয়ে প্রার্থিতালিকা ঘোষণার আগে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে বৈঠকেও বসতে হয়েছিল। কিন্তু গ্রহণযোগ্য সমাধান সূত্র বের করতে না পেরে এ বার নুরুজ্জমানকেই ওই কেন্দ্র থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে, মনে করছে দলের একটি অংশ।

সে ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু-প্রধান দেগঙ্গায় প্রার্থী করা হয়েছে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সভাধিপতি রহিমা মণ্ডলকে। বনগাঁর বাসিন্দা রহিমাকে ‘বাইরের প্রার্থী’ হিসাবে এনে দলের অন্দরের কোন্দল সামাল দেওয়া যাবে বলে মনে করেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বও।

যদিও নিজেকে বাইরের প্রার্থী বলতে নারাজ রহিমা। এমনিতে ‘ভাবমূর্তি’ স্বচ্ছ্বই বলা চলে তাঁর। জেলা পরিষদের সভাধিপতি হিসাবে গত কয়েক বছরে নামডাকও হয়েছে তাঁর। রহিমার কথায়, ‘‘জেলা পরিষদের কাজের সূত্রে দেগঙ্গায় আমাকে প্রায়ই যেতে হয়। ফলে আমাকে বাইরের লোক বলার কী কারণ? দল যে নতুন দায়িত্ব দিয়েছে, তা অবশ্যই পালন করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE