মেদিনীপুরে বিদ্যাসাগর হলের সভায় শিশির অধিকারী ও সুব্রত বক্সী। রবিবার। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ
শুদ্ধকরণের আপ্রাণ চেষ্টায় এ বার জুড়ে গেলেন সুব্রত বক্সীও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ে ছেড়ে যাওয়া আসনে সাংসদ এবং তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি এ দিন মেদিনীপুরে সাবধান করেছেন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠা নেতা-কর্মীদের। বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই চলতে থাকলে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নিতে আর বেশি দিন লাগবে না। কারণ, পরিবর্ত দল এসে গিয়েছে। তারা ঘাড়ের উপরে নিঃশ্বাসও ফেলছে।
তাঁর এই কথায় কতটা চিঁড়ে ভিজেছে, তা অবশ্য বোঝা সম্ভব হয়নি। তবে বিজেপির দ্রুত উত্থানে আর্থিক-সহ নানা কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে থাকা তৃণমূল যে মরিয়া হয়ে মুখরক্ষার পথ খুঁজে চলেছে, সেটা আরও এক বার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, গত সাড়ে তিন বছর ধরে যে সব নেতা-কর্মী নেতৃত্বকে তুষ্ট রেখে এলাকায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তাঁরা কি এক লহমায় বদলে যাবেন? নাকি বারবার এই বার্তা দেওয়ার পিছনে নিজেদের ভাবমূর্তি মেরামত করাটাই তৃণমূল নেতৃত্বের আসল উদ্দেশ্য? তা-ই যদি হয়, এ ভাবে কি সেটা সম্ভব প্রশ্ন করছেন তৃণমূলেরই একটি অংশের কর্মী-সমর্থকেরা।
এ দিন কী বলেছেন সুব্রতবাবু? মেদিনীপুর শহরে আগামী ২৪ নভেম্বর সাংগঠনিক সভা করবেন তৃণমূল নেত্রী মমতা। তারই প্রস্তুতি হিসেবে এ দিন পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের নেতা-কর্মীদের নিয়ে মেদিনীপুর শহরের কর্মিসভায় সুব্রতবাবু বলেছেন, “বলতে দ্বিধা নেই, লোকসভা ভোটের আগে আত্মসন্তুষ্টি এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে আমাদের কেউ কেউ বোধহয় ভেবেছিল, মানুষ গোলাম হয়ে গিয়েছে! এখনও অনেকে আত্মসন্তুষ্টি থেকে বেরোতে পারছে না। বিজেপির প্রভাব বাড়ছে, এটা উপলব্ধি করারই চেষ্টা করছে না।” এর পরেই তিনি হুঁশিয়ার করে দেন সকলকে মানুষ দল থেকে বিমুখ হয়ে গেলে চাওয়াও থাকবে না, পাওয়াও থাকবে না! ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক কর্মীদের কাজ ফুরিয়ে যায় না, এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাঁর মন্তব্য, “এটা আমাদের কেউ কেউ ভুলে গিয়েছেন।”
সুব্রতবাবু এমন কথা বলার এক দিন আগে তৃণমূল সূত্রে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, কলকাতা পুরভোটের ক্ষেত্রে ভাবমূর্তির নিরিখেই প্রার্থী বাছবে দল। যে সব কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে আর্থিক-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের কাছ থেকে গত পাঁচ বছরের সম্পত্তির হিসেব নেওয়া হবে। রবিবার সুব্রতবাবু এই কথাটাই একটু ঘুরিয়ে বলেছেন, “ফুলেফেঁপে কলাগাছ হলে চলবে না, বিজেপি-র বিপদ সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে।” দলের নেতা-কর্মীদের সামনে রাজ্য সভাপতির স্বীকারোক্তি, “অস্বচ্ছতা আমাদের মানুষের কাছ থেকে পিছিয়ে দিয়েছে। একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল আমাদের কাঁধে নিঃশ্বাস ফেলছে।”
কেন এমন বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব?
দলীয় সূত্রেই বলা হচ্ছে, সারদা কেলেঙ্কারি, যাদবপুর, বর্ধমান থেকে মাখড়া-কাণ্ড একের পর এক ঘটনায় দল এখন ধারাবাহিক বিড়ম্বনায়। এর উপরে ঘাড়ে বিজেপির নিঃশ্বাস। যার প্রমাণ মিলেছে সাম্প্রতিক লোকসভা ভোট থেকে বিধানসভা উপনির্বাচন পর্যন্ত, সব ফলেই। দলে আত্মতুষ্টি ঢুকে পড়েছিল লোকসভা ভোটের আগেই এমন কথা বলে এ দিন সুব্রতবাবু বিজেপির উত্থানের পিছনে কারণটিই স্পষ্ট করতে চেয়েছেন।
সারদা-কাণ্ডে সিবিআইয়ের ফাঁস চেপে বসার পর থেকেই দল পরিচালনায় তাঁর ‘আহমেদ পটেল’ মুকুল রায়ের ক্ষমতা খর্ব করে ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব বাড়িয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। পাশাপাশি সাংগঠনিক দায়িত্ব বাড়ানো হয়েছে মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও রাজ্য সভাপতি সুব্রতবাবুর। ‘টিম অভিষেকে’র সঙ্গে তাল রেখেই চলছেন পার্থ-সুব্রত জুটি। দু’দিন আগেই দলে বেনো জল রোখার বার্তা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক। এ বার দলীয় কর্মীদের সাবধান করলেন সুব্রতবাবু। সে দিক থেকে সুব্রতবাবুর এ দিনের সতর্কবার্তা অভিষেক-লাইনের ফসল বলেই মনে করছে তৃণমূলের একাংশ।
কিন্তু এত করেও কি উদ্দেশ্য সফল হবে? এই প্রশ্ন তৃণমূলেরই বিভিন্ন স্তরে ঘুরতে শুরু করেছে এখন। এই সব নেতা-কর্মীরা বলছেন, কলকাতা পুরভোটে স্বচ্ছতার কথা প্রচার করে বা রুদ্ধদ্বার কর্মিসভার বক্তব্য কৌশলে বাইরে জানিয়ে হয়তো এক ধরনের প্রচার সম্ভব। কিন্তু সেই প্রচারে আদৌ মানুষ ভুলবে কি? কারণ, এত দিন ধরে দলের শীর্ষস্তরের নেতাদের একাংশকে নানা ভাবে তুষ্ট করেই তো এলাকায় রমরমা হয়েছে এক শ্রেণির নেতা-কর্মীর। কেমন সেই পন্থা? এরও উদাহরণ উঠে এসেছে সুব্রতবাবুর এ দিনের কথায়, “কেউ আমার স্ত্রীকে মোটরবাইকে করে চাকরিস্থলে পৌঁছে দেয় বলে তাঁকে দলের সাধারণ সম্পাদক করে দিলাম, আর যে ধান ঝেড়ে পার্টিটা করে, সে দলে সম্মান পেল না এটা হবে না।” এই অবস্থা চলতে থাকলে এর পরে যে মমতার ছবি দেখিয়েও কাজ হবে না, সেটাও বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি।
সুব্রতবাবু কথাগুলো এখন বলছেন। কিন্তু তার আগেই সাম্প্রতিক কালে একাধিক বার নেতা-কর্মীদের আচরণ শোধরানো, সিন্ডিকেট বা তোলাবাজিতে না জড়ানোর জন্য সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন স্বয়ং মমতা। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। তোলাবাজি বন্ধ হয়নি, সিন্ডিকেট বা তোলাবাজির বখরা নিয়ে গোষ্ঠী-সংঘর্ষে রক্তপাতেও ইতি পড়েনি।
এই অবস্থায় জেলার কর্মীদের সামনে সুব্রতবাবুদের হুঁশিয়ারি শেষ পর্যন্ত কাজে দেবে কি না, প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরাও। এমনকী, অভিষেক বা সুব্রতবাবুরা যখন এমন স্বচ্ছতার বার্তা ঘোষণা করছেন, সেই সময়েই মুকুলবাবুর নেতৃত্বে জেলা পরিষদ পর্যন্ত ভাঙিয়ে নেওয়া হচ্ছে! তা হলে শুদ্ধকরণ কি কেবলই কথার কথা, প্রশ্ন তুলে কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান বলেছেন, “কাউন্সিলর থেকে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের কিছু বাসিন্দা ও তাদের আত্মীয়, সব একই অবস্থা। ঠগ বাছতে গেলে তৃণমূলে গাঁ উজাড় হবে।”
বাম জমানার শেষ দিকে সিপিএমও বারবার শুদ্ধকরণের কথা বলেছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে নিট ফল শূন্য। ক্ষমতা হারাতে হয়েছে তাদের। এ বারে তৃণমূলেরও কি তেমনই অবস্থা হবে?
সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলেন, “পাড়ায় তৃণমূলের দাদা থেকে কাউন্সিলর, বিধায়ক থেকে সাংসদ, মন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার ফুলেফেঁপে কলাগাছ কেন, বটগাছ হয়ে ঝুরি নেমে গিয়েছে।” নৈতিকতার প্রসঙ্গেই উল্লেখ করেছেন, কী ভাবে সম্প্রতি উত্তর দিনাজপুর ও আলিপুরদুয়ার জেলা পরিষদ দখল করেছে তৃণমূল।
যাদের উত্থান সামনে রেখে সুব্রতবাবুর হুঁশিয়ারি, সেই বিজেপির বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলছেন, “তৃণমূলের একমাত্র নীতি ছিল সিপিএম-বিরোধিতা। সরকারে আসার পরে কস্তুরীর গন্ধে মত্ত হরিণের মতো তারা নিজেরাই ক্ষমতার গন্ধে পাগল হয়ে গিয়েছে! তার ফল যা হওয়ার, তা-ই হচ্ছে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy