বাজার নেই জেনেও, শিল্পীরা কাজ করে চলেছেন। —নিজস্ব চিত্র।
অভাব প্রযুক্তির। অভাব যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সুযোগের। অভাব রয়েছে পুঁজিরও। এই ত্রিফলার খোঁচাতেই খোঁড়াচ্ছে বীরভূমের কাঁসা-পিতল শিল্প। ধুঁকছে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় শদুয়েক পরিবার।
ইলামবাজারের টিকবেতা গ্রামে এলেই চিত্রটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এখানেই কাঁসা-পিতল শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অর্ধেক পরিবারের বাস। দিনভর ঠুং-ঠাং ধাতব শব্দ এলাকায়। এই প্রচণ্ড গরমেও ঘাম ছুটিয়ে কঠোর পরিশ্রমের পরে পিতলের যে কলসি ও ঘটগুলি তাঁরা তৈরি করছেন, তার ক’টি বিক্রি হবে, তা নিয়ে সংশয়। তাও জেনেই এই শিল্পেই আটকে আছেন তাঁরা। অথচ যা রোজগার তাতে সংসার চলে না। কারণ কাঁসা-পিতলের বাসনের চাহিদা মধ্যবিত্ত বাড়িতে কার্যত বিয়েবাড়ি ও পুজো পার্বনে সীমিত রয়ে গিয়েছে। আর কাঁসা-পিতলের যে সব জিনিসের বাজার রয়েছে, যেমন ঢালাই ও মিনাকরা বিভিন্ন শৌখিন জিনিস, সে সব বানাতে জানেন না এই শিল্পীরা। তাঁদের আক্ষেপ, ‘‘কে দেবে আমাদের ওই সব শৌখিন জিনিস তৈরির প্রশিক্ষণ? পুঁজির প্রয়োজনও তো কম নয়!’’ ফলে পিছিয়েই যাচ্ছেন টিকরবেতার শিল্পীরা।
শুধু ওই গ্রামই নয় বোলপুরের ছোটশিমুলিয়া, খয়রাশোলের পাথরকুচি, লাউবেড়িয়া, হজরতপুর, লোকপুর থেকে দুবরাজপুরেও কাঁসা-পিতলের কারিগরেদের অবস্থাও একই। বহুবছর আগে থেকে বংশ পরম্পরা ধরে চলতে থাকা এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ওই পরিবারগুলি। অথচ অবস্থার পরিবর্তন হতেই পারত। এমন সুযোগ দরজা পর্যন্ত চলেও এসেছিল। কিন্তু সেই সুযোগ প্রায় হাতছাড়া হওয়ার জোগাড় হয়েছে। এ জন্য নিজেদের দারিদ্র এবং সরকারের উদাসীনতাকেই দুষছেন শিল্পীরা।
এমনটা ভাবার কারণ কী?.
প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কী ভাবে নিজেদেরকে বর্তমানের জন্য প্রস্তুত করতে পারা যায়, মূলত সেই ভাবনা থেকেই ইলামবাজারের ঠিকরবেতা গ্রামে তৈরি হয়েছিল ‘বীরভূম ব্রাস অ্যাণ্ড বেলমেটাল ক্লাস্টার ইন্ড্রস্ট্রিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি’। সময়টা ২০০৮ সাল। তবে শুধু নিজেদের গ্রামের কারিগরদের জন্যই নয়, জেলায় যে সব পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রথমত তাঁদের প্রত্যেককে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসাই উদ্দেশ্য ছিল ওই সমবায়ের। সেই মতো টিকরবেতা ছোট শিমুলিয়া, খয়রাশোলের পাথরকুচি, লাউবেড়িয়া ও হজরতপুরের কাসাঁ–পিতল শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মোট ১৮৫ জন কারিগর সমবায়ে যুক্ত হন। সম্পাদক প্রবীর সালুই, সদস্য নবদ্বীপ কর্মকার বলছেন, ‘‘আমরা সমবায় গড়েছিলাম একটা নিজস্ব কমন ফেসিলিটেড সেন্টার করব বলে। সেখানে যেমন উপযুক্ত যন্ত্রপাতি থাকবে, তেমনই প্রশিক্ষণ দেওয়ারও ব্যবস্থা থাকবে। এ ছাড়া কারিগরদের তৈরি করা দ্রব্য বিক্রি করারও বন্দোবস্ত করা হবে। উদ্দেশ্য সফল করতে জেলা শিল্প দফতরের ব্যবস্থাপনায় ভিন্ রাজ্য থেকে ২০ জনের একটি দল প্রশিক্ষণও নিয়ে এসেছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আর এগোল না।’’
রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারের আমলে জেলা পরিষদের অর্থ সাহায্যে একটি জায়গাও কেনা হয়। একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও রয়েছে সমবায়ের। কিন্তু এই পর্যন্ত হওয়ার পর আর কাজ এগোয়নি। কবে ভবন তৈরি হবে, কবে তাঁদের আশা বাস্তবায়িত হতে দেখবেন ওই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কারিগরেরেরা সেটা অজানাই থেকে গিয়েছে। সমবায়ের সম্পাদকের অভিযোগ, ‘‘শিল্পী হিসেবে সরকারের দেওয়া পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও ক্ষুদ্র বা মাঝারি ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কগুলির সহযোগিতা পাচ্ছেন না শিল্পীরা।’’ জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি তথা সিপিএম নেত্রী অন্নপূর্ণা মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘মৃতপ্রায় শিল্পটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে আমাদের সরকার পরিকল্পনা নিয়েছিল। সমবায়ের ভবনের জন্যও টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। কিন্তু তখনও জায়গা কেনা না হওয়ায় তা কাজে লাগানো যায়নি। পরে যখন জায়গা নেওয়া হল ততদিনে রাজনৈতিক পালাবদল হয়ে গিয়েছে। এরপর না সরকার, না সংশিষ্ট দফতর কোনও তরফেই সেই আগ্রহ না থাকায় পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যায়নি।’’
এখন ঠিক কী অবস্থা জানতে হলে জেলা শিল্পকেন্দ্রের জেনারেল ম্যনেজার তন্ময় ব্রহ্ম বলেন, ‘‘এমন শিল্পীদের ক্ষেত্রে সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা থাকার কথা নয়। যদি তাঁরা কাজ করতে চান এবং পরিকল্পনা সঠিক থাকে, তাহলে মোট প্রকল্প ব্যয়ের ১০ শতাংশ জমা দিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে ঠিক কী অবস্থা, খোঁজ নিয়ে বলতে হবে।’’ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রকল্প ব্যয়ের ১০ শতাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় রয়েছেন ওই কাঁসা-পিতল শিল্পের সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলি। তাই বিষয়টি খুব একটা এগোয়নি। অন্যদিকে তৃণমূলের জেলা নেতা তথা রাজ্যের মৎস্য মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ অভিযোগ তুলেছেন, ‘‘কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বাম আমলে একটা জায়গা কেনা হয়েছিল মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। বোলপুরের লেদার কমপ্লেক্স, রাজনগরের তসর এবং টিকরবেতায় কাঁসা-পিতলের শিল্পকে বাঁচাতে পরিকল্পনা করে অর্থ সাহায্যের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছিল। শুধুমাত্র বোলপুরের লেদার কমপ্লেক্সের জন্যই সাহায্য পাওয়া গিয়েছে। তবে বাকি দু’টি ক্ষেত্রেই প্রকল্পগুলির বাস্তবায়িত হওয়া প্রয়োজন।’’ তাঁর দাবি, তাঁরা অন্তরিক ভাবে সেই চেষ্টা করছেন।
কারিগরদের আক্ষেপ, এখন মহাজনের মাধ্যমেই তাঁদের কাজ করতে হয়। সেই চক্র কেটে বেরিয়ে স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ কি অধরাই থেকে যাবে? প্রশ্ন শিল্পীদের। টিকরবেতা গ্রামের হারাধন মেহতরী, জীতেন সালুই, চতুরা সালুইদের কথায়, ‘‘ভীষণ পরিশ্রমের কাজ। নানা সমস্যার মধ্যেও শিল্পটাকে ধরে রেখেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy