বন্দরের সেই জবরদখল হওয়া জমি। দেখা যাচ্ছে স্টুডিওর শেড (ইনসেটে ভেঙ্কটেশের কর্ণধার শ্রীকান্ত মোহতা)। — নিজস্ব চিত্র।
শপিং মলের বিতর্কিত চুক্তির সুবাদে তিনি ইতিমধ্যে শিরোনামে। কর ফাঁকির অভিযোগ পেয়ে তাঁর ডেরায় তল্লাশি করতে গিয়ে প্রশাসনকে হাত গুটিয়ে ফিরতে হয়েছে। শাসক দলের সমর্থনে শিল্পী-মিছিলের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবেও তাঁর নজরকাড়া উপস্থিতি। এ বার তাঁরই নাম জড়িয়ে গেল বন্দরের বিপুল জমি দখলদারির সঙ্গে। যে অভিযোগ সম্পর্কে নিষ্ক্রিয় থাকার জন্য পুলিশ-প্রশাসনের দিকেও আঙুল উঠছে।
তিনি শ্রীকান্ত মোহতা। পেশায় চলচ্চিত্র প্রযোজক। বর্তমানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অতি ঘনিষ্ঠ’ বৃত্তের গুরুত্বপূর্ণ মুখও বটে। শাসকদলের পদাধিকারী না-হয়েও তাবড় নেতাদের পিছনে ফেলে তিনি এখন নেত্রীর নিত্য দিনের ছায়াসঙ্গী। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সরকারি কমিটিতে থেকে ছড়ি ঘোরান, পাশাপাশি দিদির পক্ষে মিছিলও সংগঠিত করেন। স্বভাবতই প্রশাসনের কর্তারা তাঁকে ঘোরতর সম্ভ্রমের চোখে দেখেন। অভিযোগ উঠেছে, শ্রীকান্তেরই প্রযোজনা সংস্থা ‘শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস’ কলকাতা বন্দরের ১০০ কাঠা জমি জবরদখল করে পাঁচ-পাঁচটি স্টুডিও চালাচ্ছে। হাইড রোডে ওই আয়তনের জমির বাজারদর অন্তত পঞ্চাশ কোটি টাকা। বন্দর-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: তাঁরা বারবার চেষ্টা করেও জমির দখল নিতে পারছেন না, কারণ পুলিশ (বিশেষত তারাতলা থানা) সাহায্য করছে না।
মুখ্যমন্ত্রীর একান্ত অনুচরের বিরুদ্ধে এ হেন গুরুতর অভিযোগ ঘিরে নবান্নের আনাচে-কানাচে যেমন, তেমন শাসকদল তৃণমূলের অন্দরেও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। শ্রীকান্তকে নিয়ে বিতর্ক অবশ্য নতুন নয়। কিছু দিন আগে কর ফাঁকির অভিযোগে বাণিজ্য-কর অফিসারেরা তাঁর অফিসে হানা দিয়েছিলেন। নবান্নের ফোন পেয়ে তল্লাশি শিকেয় তুলে তাঁদের তড়িঘড়ি ফিরতে হয়। আবার লেক মলের লিজ-চুক্তিতে শ্রীকান্তের ডেভেলপার সংস্থাকে নিয়ম ভেঙে ‘সুবিধা পাইয়ে দেওয়া’র জন্য কাঠগড়ায় উঠেছে কলকাতা পুরসভা। লিজ-চুক্তিতে নির্ধারিত স্ট্যাম্প ডিউটি ও রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে শ্রীকান্তের আপত্তি ছিল। তাই ২৪ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হবে জেনেও পুর-কর্তৃপক্ষ ৬০ বছরের লিজ-চুক্তি দু’ভাগে ভাঙার প্রস্তাব মেয়র পরিষদে পাশ করিয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য রাজ্য সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে।
এবং বিতর্কের ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন বন্দরের জমিতে দখলদারি। ব্যাপারটা ঠিক কী?
বন্দর-সূত্রের খবর: পি ৫১, হাইড রোডের প্রায় ১৮৫ কাঠা জমি ১৯৬৯-এ বার্ষিক ভাড়ার চুক্তিতে তিরিশ বছরের লিজে দেওয়া হয়েছিল ওজনযন্ত্র নির্মাতা সংস্থা অ্যাভেরি ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডকে। ১৯৯৯-এ লিজের মেয়াদ ফুরোলে বন্দর-কর্তৃপক্ষ জমি ফেরাতে গিয়ে দেখেন, অন্তত চার-পাঁচটি সংস্থা সেখানে স্থায়ী কাঠামো বানিয়ে ফেলেছে। তাদের হটিয়ে জমি হেফাজতে নিতে ২০০০ সালে মামলা করেন বন্দর-কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট ‘দ্য পাবলিক প্রেমিসেস (এভিকশন অব আনঅথরাইজড অকুপ্যান্টস) ১৯৭১’ আইন মোতাবেক কেন্দ্রীয় সংস্থার বেহাত জমি সংক্রান্ত মামলা শুনতে ‘ইন্ডিয়া গেজেটে’ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এস্টেট অফিসার নিয়োগ করা হয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মতো এ ক্ষেত্রে এস্টেট অফিসারের এজলাসই শুনানি গ্রহণের একমাত্র অধিকারী।
মামলায় অ্যাভেরি’র তরফে হাজির হয় এক সংস্থা এলএমজে কনস্ট্রাকশন। সংস্থাটি দাবি করে, তারাই জমি দেখভাল করত, সুতরাং তাদের নামে জমি ফের লিজ দেওয়া হোক। মামলা চলে এগারো বছর। ২০১১-র ৭ মার্চ এস্টেট অফিসার রায় দেন, যাবতীয় দখল হটিয়ে জমিটি বন্দরের হাতে তুলে দিতে হবে। রায় চ্যালেঞ্জ করে এলএমজে বিভিন্ন কোর্টে মামলা ঠোকে। সেগুলো চললেও কেউ রায়ে স্থগিতাদেশ দেয়নি। তাই জমি হাতে নিতে বন্দর ফের তোড়জোড় শুরু করে। আর তখনই নতুন বেআইনি নির্মাণের হদিস মেলে।
সময়টা ছিল ২০১২-র জুন। বন্দরের ভূমি বিভাগের খবর: অফিসারেরা গিয়ে দেখেন, জমির প্রায় একশো কাঠা জুড়ে একাধিক শেড তুলে ভিতরে স্টুডিও তৈরি হচ্ছে। তাঁরা কাজ বন্ধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে জানা যায়, ভেঙ্কটেশ ফিল্মস ওখানে পাঁচটি স্টুডিও বানাচ্ছে। তারাতলা থানায় নালিশ রুজু হলেও অজ্ঞাত কারণে পুলিশ হাত গুটিয়ে থাকে। ভেঙ্কটেশের স্টুডিওর গায়ে আঁচড়ও পড়ে না।
পরবর্তী দু’বছরে বেহাত জমি ফিরে পাওয়ার একাধিক চেষ্টা জলে গিয়েছে। বন্দর-কর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৩-র ১০ জুলাই ফের তাঁরা জমির দখল নিতে যান, এবং বাধার মুখে ফিরে আসেন। পুলিশ যথারীতি নির্লিপ্ত থাকে। অগত্যা বন্দর আবার এস্টেট অফিসারের এজলাসে মামলা করে। ২০১৩-র ২৬ অগস্ট এস্টেট অফিসার নতুন করে নির্দেশ দেন, সমস্ত জবরদখল সরিয়ে বন্দর জমির দখল নেবে, যে কাজে সহযোগিতা করবে পুলিশ। কিন্তু বন্দর-কর্তাদের অভিযোগ, এ পর্যন্ত পুলিশের কোনও সহযোগিতা মেলেনি। শত কাঠার জবরদখলি জমিতে ভেঙ্কটেশের স্টুডিও ব্যবসা চলছে রমরমিয়ে। সংস্থা-সূত্রের খবর, ওখানকার পাঁচটি ফ্লোরে বিভিন্ন টিভি সিরিয়ালের শু্যটিং হয়। “সে বাবদ এক পয়সাও ভাড়া পাই না।”আক্ষেপ এক বন্দর-কর্তার।
পুলিশ কেন নড়েচড়ে বসছে না?
কলকাতা পুলিশের দক্ষিণ-পশ্চিম ডিভিশনের ডিসি রশিদমুনির খানের ব্যাখ্যা, “পুলিশ সাধারণত দেওয়ানি মামলায় হস্তক্ষেপ করে না।” ডিসি এ-ও জানিয়েছেন, পুলিশের উদ্দেশে আদালতের দেওয়া নির্দেশটি বন্দর-কর্তৃপক্ষ যদি দেখান, তা হলে পুলিশ পাঠাতে আপত্তি নেই। “তবে বন্দরের কেউ তো আমার কাছে আসেননি!” বলেছেন তিনি। যদিও বন্দরের ভূমি-অফিসারদের দাবি: তাঁরা খাস লালবাজারের বড় কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তবু পুলিশের উপরমহল আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বন্দরের চেয়ারম্যান রাজপালসিংহ কাহালোঁর কথায়, “যে জমি বন্দরের, আজ বা কাল তার দখল নিতেই হবে। তাই বেআইনি দখলদার সরাতে হবে। আমরা সেই মতো এগোচ্ছি।”
জমি বেহাত হল কী করে? আদতে যাদের সঙ্গে লিজ-চুক্তি হয়েছিল, তারা কী বলে?
অ্যাভেরি ইন্ডিয়া’র এক মুখপাত্রের জবাব, “ওটা এলএমজে দেখাশোনা করে। ওদেরই জিজ্ঞাসা করুন।” এলএমজে’র অন্যতম কর্ণধার সুশীলকুমার জৈন প্রশ্ন শুনে আকাশ থেকে পড়লেন “কিছু তো জানি না! আমাদের অফিসার গৌতম মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলুন।” আর গৌতমবাবুর সাফ কথা, “আমাদের সম্পত্তি নিয়ে আপনাকে বলতে যাব কেন? জানতে হলে বন্দরের কাছে জানুন।”বন্দরের ভূমি বিভাগের কর্তারা অবশ্য জানিয়ে রেখেছেন, ১৮৫ কাঠার জমিটির বাজারদর অন্তত একশো কোটি টাকা। তার যে একশো কাঠা ভেঙ্কটেশের দখলে, তা থেকে বছরে প্রায় আধ কোটি টাকা ভাড়া পাওনা হয়। বন্দরের ভাঁড়ারে ভাড়া বাবদ এক পয়সা আসে না ঠিকই, তবে জমির দখলদারেরা দিব্যি তা ভাড়ায় খাটিয়ে মোটা মুনাফা লুটছে বলেও শোনা যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন, দখল করা জমি কে কাকে ভাড়ায় দিচ্ছে? কারাই বা আসল জবরদখলকারী?
বন্দর-কর্তাদের বক্তব্য: অ্যাভারির সঙ্গে লিজ-মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে জমিতে যারা আছে, প্রত্যেকে জবরদখলকারী। কে কার কাছে ভাড়া নিয়ে নিত্যনতুন দখলদার বসাচ্ছে, তা বিবেচ্য নয়। এক আইনজীবীর ব্যাখ্যা, “স্থানীয় বাহুবলীকে প্রণামী দিয়ে কেউ অন্যের জমিতে গেড়ে বসলে আইনের চোখে সে-ও জবরদখলকারী। ওখানে বাস করার জন্য কাকে সে কত টাকা দিয়েছে, তা দেখা হবে না।” বন্দর-জমিতে ভেঙ্কটেশের কব্জা প্রসঙ্গেও এই যুক্তি দিচ্ছেন বন্দরের আধিকারিকেরা। এলএমজে কিংবা ভেঙ্কটেশ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে কোনও সংস্থার কেউ রাজি হননি। গোটা ঘটনার কেন্দ্রে যিনি, মুখ্যমন্ত্রীর সেই খাস অনুচর কী বলেন?
জানার জন্য শ্রীকান্তের মোবাইলে বহু বার ফোন করা হয়েছিল। ধরেননি। এসএমএস করা হলেও কোনও জবাব মেলেনি।
তিনি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy