Advertisement
১৮ মে ২০২৪

হেল্পলাইনে ফোন করে নিজের বিয়ে রুখল নাবালিকা

রাত ন’টা নাগাদ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হেল্পলাইনে ভেসে এল এক কিশোরীর গলা। “কাকু, আমার বাড়ি ধাপায়। আমায় জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি পড়াশোনা করতে চাই।” আর দেরি করেননি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা। বৃহস্পতিবার রাতেই তাঁরা সোজা গিয়ে হাজির হন প্রগতি ময়দান থানায়। সেখান থেকে পুলিশ অফিসারদের নিয়ে ধাপা এলাকার বৈঁচতলায়, মেয়েটির বাড়িতে। শুক্রবারই ওই কিশোরীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিয়ের সেই আয়োজনের মধ্যে থেকেই মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় নিরাপদ আশ্রয়ে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৪ ০১:৫৩
Share: Save:

রাত ন’টা নাগাদ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হেল্পলাইনে ভেসে এল এক কিশোরীর গলা। “কাকু, আমার বাড়ি ধাপায়। আমায় জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমি পড়াশোনা করতে চাই।”

আর দেরি করেননি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা। বৃহস্পতিবার রাতেই তাঁরা সোজা গিয়ে হাজির হন প্রগতি ময়দান থানায়। সেখান থেকে পুলিশ অফিসারদের নিয়ে ধাপা এলাকার বৈঁচতলায়, মেয়েটির বাড়িতে। শুক্রবারই ওই কিশোরীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিয়ের সেই আয়োজনের মধ্যে থেকেই মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় নিরাপদ আশ্রয়ে।

শুক্রবার ওই কিশোরীকে হাজির করানো হয় কলকাতা শিশুকল্যাণ সমিতির অফিসে। সমিতির নির্দেশে ওই কিশোরীর ঠিকানা আপাতত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হোম। গোটা ঘটনাটি তদন্ত করে দেখার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন শিশুকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান অমিত ভট্টাচার্য।

পুলিশ জানিয়েছে, নাবালিকাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে ওই কিশোরীর বাবাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুরু করা হয়েছে মামলাও। খোঁজ করা হচ্ছে পাত্রপক্ষেরও।

এ রাজ্যে নাবালিকা বিয়ের ইতিহাসে পুরুলিয়ার নাম উঠে এসেছে। একই সঙ্গে উঠে এসেছে ওই জেলার রেখা কালিন্দি, আফসানা খাতুন, সুনীতা মাহাতো, বীণা কালিন্দি, সঙ্গীতা বারুইয়ের মতো সাহসিনী কিশোরীদের নামও। এদের মধ্যে রেখাই প্রথম নিজের বিয়ে নিজে রুখেছিল। বলেছিল, সে আরও পড়তে চায়। পরবর্তী কালে রেখাকে অনুসরণ করে বাকি চার জনও। এবং এই পাঁচ সাহসিনী পুরুলিয়া জেলায় আরও অনেক নাবালিকা বিয়ে রুখেছিল। এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিলের কাছ থেকে পুরস্কারও পায় তারা। পুরস্কার দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, “এই পাঁচ কিশোরী সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত।’’ এ বার নাবালিকার বিয়ে রুখে দেওয়ার সেই পুরুলিয়া মডেল ঢুকে পড়ল খাস কলকাতা শহরেও।

কলকাতার শিশুকল্যাণ সমিতির কর্তারা জানাচ্ছেন, এই শহরে নাবালিকা বিবাহের ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে বস্তি এলাকাগুলিতে এমন ঘটনার খবর মেলে। অমিতবাবু জানান, নাবালিকা বিয়ে-বিরোধী সচেতনতা বাড়াতে ওই এলাকাগুলিতে প্রচার চালানো হয়। তবে নিজে এগিয়ে এসে সরাসরি ফোন করে নিজের বিয়ে আটকে দেওয়ার ঘটনার নজির প্রায় নেই বললেই চলে।

ঠিক কী ঘটেছিল বৃহস্পতিবার রাতে?

পুলিশ সূত্রের খবর, ধাপার ওই কিশোরীর বয়স ষোলোর কোঠায়। স্থানীয় একটি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী সে। দমদমের এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কো-অর্ডিনেটর দিলীপ বসু জানান, দিন চারেক আগেই বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল বলে মেয়েটি জানিয়েছে। কিন্তু সে বা তার পরিবারের কেউই পাত্র সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানত না বলে প্রাথমিক তদন্তের পরে জানিয়েছে পুলিশ। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তাদের মেয়েটি জানিয়েছে, পাত্রকে সে চোখেও দেখেনি। সে যে এখন বিয়ে করতে চায় না, বরং পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় এ কথাও সে বলেছে উদ্ধারকারীদের। মেয়েটি জানিয়েছে, বাবা-মা কে সে এ কথা জানিয়েছিল। কিন্তু তাঁরা তাতে কর্ণপাত না করে জোর করে মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বলে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তারা জানিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই মেয়েটি বিয়ের আগের রাতে এক বান্ধবীর মোবাইল থেকে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে ফোন করে ঘটনার কথা জানায়।

পুলিশ সূত্রের খবর, মামলা করা হয়েছে পাত্রপক্ষের বিরুদ্ধেও। তাঁদের পরিচয় জানতে কিশোরীর পরিবারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কিন্তু তাঁরাও বিশেষ কিছু জানেন না। পুলিশের এক কর্তা বলেন, “বস্তি এলাকা থেকে বিয়ের টোপ দিয়ে নারী পাচার করার ঘটনা আগেও ঘটেছে। এখানেও নারী পাচার চক্রের চাঁইরা জড়িত কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”

এ ভাবে কিছু না জেনেশুনেই ওই কিশোরীর অভিভাবকেরা মেয়ের বিয়ে দিচ্ছিলেন কেন?

পুলিশ জানায়, মেয়েটির পরিবার হতদরিদ্র। বাবা পেশায় হকার। নাবালিকা বিয়ে যে অপরাধ, এটা বোঝার ক্ষমতা বা শিক্ষাও তাঁদের নেই। “এমন একটি পরিবারের মেয়ের যে এতটা পড়াশোনার ইচ্ছে থাকতে পারে, এটা দেখেই ভাল লাগছে।”মন্তব্য কলকাতা পুলিশের এক কর্তার।

রাতে ওই কিশোরীর পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, জায়গায় জায়গায় জটলা করেছেন স্থানীয়েরা। মেয়েটির বাড়ি একতলা, টালির চালের। ভিতরে কয়েক জন বসে রয়েছেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি পরিচয় দিতেই ভিতরে যেতে বাধা দিলেন এলাকার কয়েক জন যুবক। বাড়ির ভিতর থেকে এক মহিলার গলা ভেসে এল, “বাড়িতে কেউ নেই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

forceful marriage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE