মায়ের সঙ্গে কুপন । —নিজস্ব চিত্র।
পড়েছিল পিছনে পুরনো ভিটে। বাবার স্মৃতি। ষষ্ঠ শ্রেণির ছেলেটি ভাইবোন আর মায়ের সঙ্গে এ পারে এসেছিল ছিন্নমূল হয়ে। কিন্তু সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দা কুপন রায়ের মাথায় যেন গেঁথে গিয়েছিল বাবা নেন্দু রায়ের ক্যানসারে, কার্যত বিনা চিকিৎসায় তিলে তিলে মৃত্যুর দিনগুলি। লড়াইটা তাই ছাড়েননি কুপন। আর্থিক বাধায় গত বছর ডাক্তারির সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট পাশ করেও পড়তে না পারার পরেও নয়। এই বছরে ফের পরীক্ষায় বসে সাফল্য। কাউন্সেলিংয়ের পরে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে সুযোগ পেলেন কুপন। এবং বললেন, ‘‘চিকিৎসক হয়ে চেষ্টা করব গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াতে। যাতে বাবার মতো কারও মৃত্যু না হয়।’’
রবিবার কথা বলতে বলতে চোখের কোণে জল মুছছিলেন কুপন। তিনি বলেন, ‘‘এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এমবিবিএস পড়ার সুযোগ পেলাম। প্রথম বার ভর্তি হতে পারিনি টাকার অভাবে। এ বার অনেকেই পাশে দাঁড়িয়েছেন।’’
কুপনেরা এখন থাকেন কোচবিহারের হলদিবাড়ির সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দাদের জন্য তৈরি আবাসনে। ভিটে ছিল ও পারে, বাংলাদেশ ভূখণ্ড দিয়ে ঘেরা কোটভাজনি ছিটমহলে। ২০১৫ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হয়। তখনই ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসেন কুপনেরা। আশ্রয় নেন হলদিবাড়িতে সরকারি শিবিরে। লড়াইয়ের সেই শুরু।
কুপন জানান, তিনি সেই সময়ে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ‘দেশ’ ছাড়ার আগেই তাঁর বাবা নেন্দু রায় ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কুপন বলেন, ‘‘ও পারে তো আমরা স্বাধীন ছিলাম না। আর্থিক অনটন নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল।’’ এ পারে এসে হলদিবাড়ি হাইস্কুলে ভর্তি হন তিনি। মাধ্যমিকে ভাল ফল করে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ২০২২ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে ৮৪ শতাংশের উপরে নম্বর মেলে। সেই সঙ্গে ওই বছরেই ‘নিট’-এ মেলে সাফল্য। কিন্তু টাকার অভাবে সেই বছর ভর্তি হতে পারেননি। আবার ‘নিট’-এর প্রস্তুতি এবং সাফল্য।
কুপন জানান, টিউশন পড়ার মতো সামর্থ্য ছিল না। স্কুলের শিক্ষকেরাই বিনে পয়সায় টিউশন পড়িয়েছেন। তার বাইরেও যখন যেখানে গিয়েছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রত্যেকে। ছেলের ফলে খুশি মা সরবালা। বলেন, ‘‘ছেলে চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করুক, এটাই চাই।’’
হলদিবাড়ি হাইস্কুলের শিক্ষক বাবলু দাস কুপনের পাশে থেকেছেন সব সময়ে। বললেন, ‘‘কুপন অন্য রকম ছেলে। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে, আর পড়াশোনা করতে।আমরা জানতাম কুপন সফলহবে। আমরা খুশি।’’ জামালদহের একটি সংস্থা কুপনের পাশে দাঁড়িয়েছে। ওই সংস্থার মৃন্ময় ঘোষ বলেন, ‘‘একে অভাব-অনটন, তার উপর ভিটে ছেড়ে আসার যন্ত্রণা। বাবা নেই। তার পরেও যে লড়াই করা যায়, তা কুপনকে দেখলে বোঝা যায়।’’
কুপনের প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্মৃতিতে কোথাও আজও ও-পার বাংলা রয়ে গিয়েছে, সেটা বোঝা যায় তাঁর গান বাছাইয়ে। সুযোগ পেলেই তিনি বলতে শুরু করেন, ‘‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি।’’ চিকিৎসক হয়ে সেই ভালবাসা আরও উজাড় করে দিতে চান কুপন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy