কপিলানন্দ মণ্ডল
মাধ্যমিকের পরে লেখাপড়া এগোনো আর হয়ে ওঠেনি। অথচ তাঁর বক্তৃতাই হাঁ করে গিলেছে মার্কিন মুলুকে শিক্ষার পীঠস্থান এমআইটি। পাঁচ মহাদেশের ৫৫টি দেশে ঘুরেছেন শুধু বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণে। অজ-পাড়াগাঁয়ে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার একফালি দফতরে যে-দৌড় শুরু হয়েছিল, তা ছুঁয়েছে যোজনা কমিশনের ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য হওয়ার মাইলফলক।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার উল্লোন থেকে ‘আশ্চর্য’ উড়ানের এই গল্পে রূপকথাকেও হার মানিয়েছেন কপিলানন্দ মণ্ডল। পাড়াগাঁয়ে স্বাবলম্বনের লক্ষ্যে তৈরি সংস্থা যে এমন বিশ্ব জোড়া পরিচিতি দেবে, তা তিনি ভাবেননি। কল্পনাতেও আসেনি যে, একদিন দক্ষিণ ২৪ পরগনার ১০টি ব্লকের ৭১০টি গ্রামের ১ লক্ষ ৩২ হাজার মানুষকে সঞ্চয়-ভিত্তিক ক্ষুদ্র-ঋণের মাধ্যমে আর্থিক সুরক্ষার বলয়ে নিয়ে আসবেন তিনি। অথচ তাঁর সম্পর্কেই বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা ও ক্ষুদ্র-ঋণের অন্যতম পথিকৃৎ মহম্মদ ইউনুস বলেছিলেন, ‘‘যা করার চেষ্টা করছি কপিল তা ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে।’’
লক্ষ্মীকান্তপুর স্টেশনে নেমে বেশ কয়েক মাইল দূরের গ্রাম উল্লোন। ১৯৯৪ সালে সেখানে ক্ষুদ্র-ঋণ সংস্থা বিবেকানন্দ সেবা-কেন্দ্র ও শিশু উদ্যান (ভিএসএসইউ) গড়ে তোলেন কপিলবাবু। সঞ্চয়ের বাধ্যতামূলক শর্তে ক্ষুদ্র-ঋণের ব্যবস্থা ও স্থানীয় সম্পদ কাজে লাগিয়ে গ্রামোন্নয়ন, ভিএসএসইউ-র এই মডেলই নজর কাড়ে ক্ষুদ্র-ঋণ দুনিয়ার। কপিলবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘ঋণ শোধ করতে প্রতিদিন, সপ্তাহে বা মাসে যে-টাকা ঋণগ্রহীতা দেন, তার একাংশ জমা হয় সঞ্চয় খাতে। ফলে ঋণ শোধ হওয়ার সঙ্গে তৈরি হয় নিজস্ব পুঁজিও।’’
এই ব্যবস্থারই ২০০৩ সালে ভূয়সী প্রশংসা করে বিশ্বব্যাঙ্কের ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে প্রকাশিত এক রিপোর্ট। আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র-ঋণ সংস্থাগুলির সামনে ‘দৃষ্টান্ত’ বলে তকমা দেওয়া হয় কপিলবাবুর প্রতিষ্ঠানকে। আর সে বছরই অশোক ফাউন্ডেশন তাঁকে ফেলো মনোনীত করে আমেরিকা পাঠায়। সেই শুরু। এমআইটি ছাড়াও বক্তৃতা দিয়েছেন টাফ্ট, সিয়েরা নেভাদা-সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। গিয়েছেন ইউরোপে।
কপিলবাবুর এই কাজের তারিফ করেছেন বিশ্বের তাবড় বিশেষজ্ঞরা। তাঁর মুখ থেকে তা জানতে চেয়েছেন অর্থনীতির পণ্ডিতরা। একাধিকবার এ নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে বক্তৃতাও করেছেন তিনি।
তবে কপিলবাবুর কথায়, সব থেকে মনে রাখার দিনটি ছিল ২০১১ সালের ৬ এপ্রিল। সে দিন তৎকালীন কেন্দ্রীয় কৃষি উপদেষ্টা ভি ভি সাদামাতে ফোনে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘অভিনন্দন। আপনাকে দ্বাদশ যোজনা কমিশনের ওয়ার্কিং গ্রুপের (আউটরিচ অব ইনস্টিটিউশনাল ফিনান্স, কো-অপারেটিভস অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট) সদস্য করা হল।’’
বয়স ষাট ছুঁইছুঁই। এখনও সাদামাটা জামাকাপড় আর গ্রামের মাটির টান আঁকড়ে থাকা কপিলবাবুর কথায়, ‘‘প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। মাধ্যমিক পাশের পর আর পড়তে পারিনি। ১৯৭৮ সালে একটি পত্রিকা অফিসে পিওনের কাজে যোগ দিই। ’৯০ সালে তা বন্ধ হওয়ায় বেকার হলাম। ’৯৪-তে শুরু ক্ষুদ্র-ঋণের কারবার। সেখান থেকে যোজনা কমিশনে যে কী ভাবে পৌঁছলাম, নিজেও ভেবে পাই না।’’
মোদী সরকারের ফরমানে এখন যোজনা কমিশনের দিন ফুরিয়েছে। তৈরি হয়েছে নীতি আয়োগ। ২০১৭ সালের ৩১ মার্চ দ্বাদশ যোজনা কমিশনের মেয়াদও ফুরোবে। তার পরে নীতি আয়োগে কপিলবাবু থাকবেন কি না, জানা নেই। তবে পিওন থেকে জীবনের পাহাড় চূড়ায় ওঠার এই স্বপ্নের দৌড় চলবে বলেই আশাবাদী তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy