শহরের চেহারাটাই বদলে গিয়েছে। ক্রমশ ঘিঞ্জি হয়েছে শহর। —নিজস্ব চিত্র।
বছর দশেক আগেও রাত দশটার পরে সুনসান হয়ে যেত কদমতলা চত্বর। এখন মাঝ রাত পার করেও মোড়ের হোটেল বা কিছুটা দূরে ডিবিসি রোডের শপিং মলে নিয়ন আলো জ্বলে। রাস্তার পাশে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে বিলাসবহুল মডেলের নামীদামি গাড়ি। বহুতল হোটেল, আবাসন, বাজারভবন ঘিরেছে জলপাইগুড়ি শহরের প্রাণ কেন্দ্র কদমতলাকে। কিছুদিন আগে শহরের জেলা গ্রন্থাগারে এক অনুষ্ঠানে এসে সাহিত্যিক দেবেশ রায় বলেছিলেন, “এক সময়ে কদমতলায় দাঁড়ালে দিগন্তে আকাশ দেখা যেত, এখন তো বহুতলে দৃষ্টি আটকে যায়।” এটাই ঘটনা। অতীতের সঙ্গে বর্তমান শহরের চেহারায় মিল প্রায় নেই। যদিও শহরের চেহারা বদলালেও তাল মিলিয়ে পরিকাঠামো বা পরিষেবা বাড়েনি বলেই প্রবীণ বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ। কদমতলা মোড়, বেগুনটারি, থানামোড়, মার্চেন্ট রোড, ডিবিসি রোডের মতো ব্যস্ত রাস্তা গত দশ বছরে সম্প্রসারণ হয়নি বলে অভিযোগ।
জন গণনার তথ্য অনুয়াযী গত দশ বছরে জলপাইগুড়ি শহরের জনসংখ্যা বেড়েছে অন্তত ১ লক্ষ। ২০১১ সালের শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ ৪ হাজার। জনসংখ্যার থেকেও দ্রুত হারে বেড়েছে একতলা থেকে বহুতলের সংখ্যা। তৈরি হচ্ছে নিত্যনতুন বাজারভবন। গলির রাস্তাতেও বহুতল আবাসনের ছড়াছড়ি। পুরসভার হিসেবেই গত দশ বছরে শহরে ‘হোল্ডিং’ অর্থাৎ বাড়ির সংখ্যা বেড়েছে অন্তত ৩০ শতাংশ। বহুতল আবাসনের সংখ্যা দেড়শোর কাছাকাছি। দু’পাশে শপিং মল, বাণিজ্যিক ভবন, বহুতলের মধ্যে সঙ্কীর্ণ হয়ে এসেছে ডিবিসি রোড। দিনবাজারের রাস্তা জুড়েই দু’চাকা-চার চাকার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। যার জেরে দিনের ব্যস্ত সময়ে তুমুল যানজট চলে গোটা শহরেই। একই অবস্থা কদমতলা, মার্চেন্ট রোড, শান্তিপাড়া, রায়কত পাড়া মোড়েরও। বাইরের চেহারা বদলালেও, ভিতরে ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে জলপাইগুড়ি শহর।
জনসংখ্যার চাপ বেড়েছে শহর লাগোয়া এলাকাগুলিতেও। ঝাঁ চকচকে বাণিজ্যিক কেন্দ্র, বহুতল আবাসন, ইন্টারনেট পার্লার সবই তৈরি হয়েছে মোহিতনগর, ঝাঁবাড়ি মোড়, ৭৩ মোড় লাগোয়া এলাকায়। গঞ্জের চেহারা বদলিয়ে পাতকাটা, পাহাড়পুরে বহুজাতিক সংস্থার আসবাব-টিভির গ্যালারি থেকে ল্যাপটপ, গাড়ির শো-রুমও তৈরি হয়েছে। এলাকাগুলিতে ‘শহুরে’ ছাপ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। পঞ্চায়েত এলাকায় থাকা সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ, জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ব্যবসা-বাণিজ্য।
রাতের বেলায় শিরিষতলা বা শান্তিপাড়ায় পুর এলাকায় অত্যাধুনিক ‘হাই-মাস্ক’ আলো জ্বললেও মোহিতনগর, পাতকাটার পঞ্চায়েত এলাকার রাস্তার দু’পাশে টিউব লাইটের মৃদু আলো, কোথাও আবার ল্যাম্পপোস্টে ঝোলে বাল্ব। গলির মুখেই, নর্দমার ধারে ডাই করা জঞ্জালের স্তুপ। নেই বাড়িতে পানীয় জল সরবারহ ব্যবস্থা, নিকাশিও। সময়ের সঙ্গে মোহিতনগর, অরবিন্দ পাহাড়পুর, পাতকাটা, খড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিতেও ক্রমশ পরিষেবার দাবি জোরালো হচ্ছে। শহর এলাকায় দাবি উঠেছে পুরসভাকে কর্পোরেশন ঘোষণার।
এই পরিস্থিতিতে হয়ে গিয়েছে জেলার ‘অঙ্গচ্ছেদ’। জলপাইগুড়ি জেলা ভাগ করে আলিপুরদুয়ার জেলা গঠনের প্রভাব জেলা সদরে কতটা পড়বে তা নিয়েও উদ্বেগে জেলা সদরের বাসিন্দারা। তবে পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসুর আশ্বাস, “মুখ্যমন্ত্রী থেকে পুরমন্ত্রী সকলেই জলপাইগুড়ি শহরকে কর্পোরেশনে উন্নীত করার আশ্বাস দিয়েছেন।”
কর্পোরেশন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি পর্ব চলছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। ২০১০ সাল থেকেই পুরসভা-জেলা প্রশাসন থেকে রাজ্য সরকারের পুর দফতর নানা অফিসে চিঠি চালাচালি হয়েছে। কয়েক প্রস্ত বৈঠক, সমীক্ষাও হয়েছে। প্রতিবারই সেই প্রক্রিয়া বৈঠক, সমীক্ষা এবং রিপোর্ট পাঠানোতেই শেষ হয়েছে। এলাকা সংযুক্তি এবং কর্পোরেশনের স্বীকৃতি তাই ‘হচ্ছে, হবে’ স্তরেই আটকে রয়েছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ।
আয়তনে বাড়লে অথবা কর্পোরেশনে উন্নীত হলেই শহরের চিত্র কি পুরোপুরি বদলে যাবে? প্রশ্ন তুলেছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান আনন্দগোপাল ঘোষ। তাঁর কথায়, “বাড়ি-ঘর বেড়েছে। চাকচিক্য বেড়েছে। এর বেশি বদল কি কিছু হয়েছে? সরকার পরিকাঠামো উন্নয়নের টাকা দিলে শহর বাড়বে। তবে তাতে করে শহর কি বাঁচানো যাবে। অর্থনৈতিক উন্নতি না হলে শহর বাঁচানো যাবে না।” তাই সমাধান কোন পথে হতে পারে? সেই প্রশ্নে বাসিন্দাদের উদ্বেগ ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy