কৃষ্ণনগর সংশোধনাগার থেকে বাড়ির পথে প্রদীপ সাহা। সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
পূর্বস্থলীর তৃণমূল নেতা সজল ঘোষ খুনের মামলায় একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তথা সিপিএম নেতা প্রদীপ সাহাকে বেকসুর খালাস করল নবদ্বীপ আদালত। তাঁর সঙ্গেই মুক্তি পেলেন আরও চার সিপিএম কর্মী। ফলে, ওই খুনে আসলে কারা জড়িত তার মীমাংসা যেমন হল না, পুলিশের ভূমিকা নিয়েও ফের প্রশ্ন উঠে গেল।
বুধবার নবদ্বীপের অতিরিক্ত এবং সেশন জজ সুধীর কুমার তাঁর সংক্ষিপ্ত রায়ে বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তাই তাঁদের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হল। অথচ তথাকথিত প্রত্যক্ষদর্শীদের (সকলে তৃণমূলের) বয়ানের ভিত্তিতে মামলা রুজু করেছিল পুলিশ। কিন্তু শুনানি যত এগিয়েছে, সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। মূল অভিযুক্ত লোকনাথ দেবনাথকেও ধরা যায়নি। তারই ফল এই রায়।
এজলাস থেকে বেরিয়ে প্রদীপবাবু বলেন, “সত্যের জয় হল।” সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদার দাবি করেন, “মিথ্যা মামলায় প্রদীপকে ফাঁসানো হয়েছিল। তৃণমূলকে মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।” রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) স্বপন দেবনাথের প্রতিক্রিয়া, “কে কী বলছেন, জানি না। আমাদের কর্মী খুন হয়েছেন। মানুষই বিচার করবে।” সজলবাবুর স্ত্রী, সদ্য প্রাথমিক স্কুলে চাকরি পাওয়া ইন্দ্রাণী ঘোষও এ নিয়ে কোনও কথা বলতে চাননি।
তবে পূর্বস্থলী উত্তরের তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায় জানান, তাঁরা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। তাঁর দাবি, “এত জন প্রতক্ষ্যদর্শীর সামনে ঘটনা ঘটল। কিন্তু তদন্তকারী অফিসার বহু জরুরি নথি পেশ করতে পারেননি। তারই মাসুল দিতে হচ্ছে আমাদের।” তদন্তকারী অফিসার বিভাস সেন এ নিয়ে কোনও কথা বলতে চাননি। নদিয়ার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ বলেন, “এটা আদালতের রায়। কিছু বলব না।”
২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি বর্ধমানের পূর্বস্থলী কলেজে টিএমসিপি এবং এসএফআই মারপিটে আহত ছাত্রদের দেখতে নবদ্বীপ হাসপাতালে গিয়ে তৃণমূলের পূর্বস্থলী অঞ্চল সহ-সভাপতি সজল ঘোষ খুন হন বলে অভিযোগ। তপনবাবুর দাবি, ওই দিন তিনিও সজলবাবুর সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। এক অজ্ঞাতপরিচয় যুবক দোতলায় ওয়ার্ডে এসে এক আহত ছাত্রকে বলে, এসএফআই সমর্থক লোকনাথ কথা বলতে চাইছে। ছাত্রটি নীচে নামলে সজলবাবুও সঙ্গে নামেন। নিজেদের প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করে পাঁচ তৃণমূল কর্মী পরে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন, সজলবাবু হাসপাতালের গেট থেকে বেরোনো মাত্র প্রদীপ সাহা এসে তাঁকে জাপটে ধরেন। তাঁরই নির্দেশে লোকনাথ পেটে বন্দুক ঠেকিয়ে সজলবাবুকে গুলি করে। পরে মোটরবাইকে চড়ে দু’জনে পালায়।
রাতেই নবদ্বীপের বাড়ি থেকে প্রদীপ সাহাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অথচ আদালতে তারা অনেক প্রশ্নেরই সদুত্তর দিতে পারেনি। যেমন: ১) পেটে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করলে তা হয় পেট ভেদ করে চলে যাবে অথবা হাড় ফাটিয়ে দেবে। সজলবাবুর ক্ষেত্রে কোনওটাই হয়নি। ২) রাত ১১টা নাগাদ সজলবাবুকে গুলি করা হয় বলে অভিযোগ। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বলছে, খুন হয়েছিল সন্ধ্যায়। ৩) ঘটনাস্থলের কাছে জরুরি বিভাগে থাকা চিকিত্সক সাক্ষ্যে জানিয়েছেন, তিনি কোনও গুলির শব্দ শোনেননি। ৪) ওই সময়ে হাসপাতালের সিঁড়িতে শুয়ে থাকা রোগীর আত্মীয়স্বজন বা উল্টো দিকে ওষুধের দোকানের কাউকে খুনের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে হাজির করতে পারেনি পুলিশ।
এত দিন বাদে প্রধান শিক্ষক খুনের অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়ায় কুলকামিনী হাইস্কুলে হইচই পড়ে যায়। বিলোনো হয় মিষ্টি। পারুলিয়া বাজারে লাল আবির নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন দলের কর্মীরা। আদালত চত্বরেই একচোখ জল নিয়ে প্রদীপবাবুর মা দীপালি সাহা বলেন, “আমার ছেলে মানুষ গড়ার কারিগর। ও কখনও মানুষ মারতে পারে?” প্রদীপবাবুর স্ত্রী শম্পা মৈত্র বলেন, “তিন বছর দাঁতে দাঁত চেপে এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। অনেক অসম্মান-অপমানের উত্তর আজ মিলল।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy