Advertisement
০৭ মে ২০২৪
হাঁসনে হতবাক অসিতই

নিজের বুথেও হার

এক জন দলবদল করে ‘জেতা’ টিমে গিয়েও গোল খেয়ে গেলেন। আর প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়টি সারা ক্ষণ গোললাইন সেভ করে হারের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সেই টিমকেই জিতিয়ে ছাড়লেন! আর তার জেরেই দীর্ঘ কুড়ি বছর পরে উলটপুরাণ হল হাঁসন কেন্দ্রে। পুরনো দল কংগ্রেসের কাছেই হারতে হল এলাকার পাঁচ বারের বিধায়ক অসিত মালকে।

তখনও কংগ্রেসে। লোকসভা ভোটে জিম্মির প্রচারে অসিত মাল। (ডান দিকে) হাঁসন জয়ের পরে মিল্টন। —ফাইল চিত্র

তখনও কংগ্রেসে। লোকসভা ভোটে জিম্মির প্রচারে অসিত মাল। (ডান দিকে) হাঁসন জয়ের পরে মিল্টন। —ফাইল চিত্র

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
মাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৬ ০২:০৬
Share: Save:

এক জন দলবদল করে ‘জেতা’ টিমে গিয়েও গোল খেয়ে গেলেন। আর প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়টি সারা ক্ষণ গোললাইন সেভ করে হারের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সেই টিমকেই জিতিয়ে ছাড়লেন!

আর তার জেরেই দীর্ঘ কুড়ি বছর পরে উলটপুরাণ হল হাঁসন কেন্দ্রে। পুরনো দল কংগ্রেসের কাছেই হারতে হল এলাকার পাঁচ বারের বিধায়ক অসিত মালকে। হারলেন যাঁর কাছে, সেই মিল্টন রশিদ আবার এলাকায় তাঁরই ‘শিষ্য’ বলে পরিচিত ছিলেন। আর সেই মিল্টনের কাছেই হারা কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না অসিতবাবু। কংগ্রেস নেতৃত্ব যদিও তাঁর এই হারের মধ্যে দলের প্রতি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র বিরুদ্ধে জনতার প্রতিবাদ হিসেবেই দেখছেন। পাশাপাশি বরাবর অসিতবাবুর ভোটের দায়িত্বে থাকা জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ‘ষড়াননে’র অন্যতম নেতা খন্দেকার মহম্মদ সফির হার বলেও দাবি করছেন কংগ্রেসের নেতারা। অসিতবাবুর মতোই হাল হয়েছে নদিয়ার শান্তিপুরের ছ’বারের কংগ্রেস বিধায়ক অজয় দে-রও। ২০১১-র ভোটে জিতেও অসিতবাবুর মতো তিনিও তৃণমূলে নাম লিখিয়েছিলেন। অবশ্য হারতে হারতে প্রায় কানঘেঁষে জিতে গিয়েছেন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়া বর্ধমানের কাটোয়ার রবি চট্টোপাধ্যায়।

ঘটনা হল, লড়াইয়ের জমিটা চার বছর আগে থেকেই শুরু করেছিলেন হাঁসন বিধানসভায় প্রথম বারের জন্য লড়া মিল্টন। অথচ ভোটের মুখে তাঁর প্রার্থী হওয়া নিয়েই টানাপড়েন শুরু হয়েছিল। কিন্তু দলত্যাগী অসিতবাবুকে হারাতে সেই মিল্টনের উপরেই ভরসা করেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। প্রথমে সিপিএম এবং ভোটের আগে দলীয় প্রার্থী তুলে নিয়ে মিল্টনের পাশে দাঁড়ায় আরসিপিআই-সহ অন্য বাম দলগুলিও। শেষপর্যন্ত ইতিহাস বদলে এই প্রবল মমতা-ঝড়ের যুগেও হাঁসন দখল নিল জোট।

যার জেরে নির্বাচনী ফলে দেখা যাচ্ছে, বিগত বিধানসভা ভোটগুলিতে যে এলাকা অসিতবাবুকে বিরাট অঙ্কের ব্যবধান দিত, সেই মাড়গ্রামই এ বার ৫,১৫৩ ভোট লিড দিয়েছে মিল্টনকে। এমনকী, মাড়গ্রামে নিজের ১৬৬ নম্বর বুথেও হেরেছেন অসিতবাবু। সেখানে মিল্টনের প্রাপ্ত ভোট ৫১৬ এবং অসিতবাবুর ৩০১। আবার মিল্টনের বুথে ফলাফল দাঁড়িয়েছে, কংগ্রেস ৪০৭ ও তৃণমূল ১২৩। দলের অস্বস্তি বাড়িয়েছেন খন্দেকার সফিও। তাঁর এলাকার বুথে অসিতবাবু পেয়েছেন মাত্র ২৬৫টি ভোট। যেখানে মিল্টনের স্কোর ৪৯২। মাড়গ্রাম ১ ও ২ পঞ্চায়েত ছাড়াও রামপুরহাট ২ ব্লকের ৯টির মধ্যে ৮টি পঞ্চায়েতেই (সাহাপুর অঞ্চল বাদে) হারের মুখ দেখতে হয়েছে তৃণমূল প্রার্থী অসিত মালকে।

এ দিকে, রাজ্য জয় করেও হাঁসনে মুখ থুবড়ে পড়ার কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না তৃণমূলের নেতারা। পাশের রামপুরহাট কেন্দ্রে চতুর্থ বার জয়ী হওয়া আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘হাঁসন আমাদের হারা উচিত ছিল না। কেন হারলাম, তা দল অবশ্যই পর্যালোচনা করে দেখবে।’’ অসিতবাবুর মতো ‘জনপ্রিয়’ নেতার হার কোনও ভাবেই মানতে পারছেন না তিনি। ফল দেখে একই রকম বিস্মিত হয়েছেন খোদ প্রার্থীও। অসিতবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। এলাকার মানুষ, দলের ছোট বড় সকল নেতৃত্ব আমার পাশে থেকে কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই করেছেন। তবু কেন হারলাম, এখনও বুঝতে পারছি না।” তবে কি তৃণমূলে চলে যাওয়াটাই কাল হল? অসিতবাবুর জবাব, ‘‘ঠিক বলতে পারব না। তবে বিরোধীরা তো ভোটের আগেই আমি হারছি সেই হাওয়াটা তুলেছিল। সেই হাওয়া ওরা হয়তো ধরে রাখতে পেরেছে।’’

অবশ্য তাঁর এই হারের একটা ব্যাখ্যা ইতিমধ্যেই দেওয়া শুরু হয়েছে স্থানীয় স্তর থেকে। দলের রামপুরহাট ২ ব্লক সভাপতি সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, ‘‘অসিতদা যখন তৃণমূলে এসেছিলেন, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য থেকে পঞ্চায়েত সদস্য সকলেই দলে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বিধানসভা ভোটে গুটি কয়েককে ছাড়া তাঁদের কাউকেই অসিতদার সঙ্গে প্রচারে ঘুরতে দেখা যায়নি।’’ তা হলে কি সর্ষের মধ্যেই ভূত? তা আর খোলসা করেননি সুকুমারবাবু। তবে, তাঁর ইঙ্গিতপূর্ণ সংযোজন, ‘‘নলহাটি ২ ব্লকে আমরা পিছিয়ে থাকব জানতাম। কিন্তু যে বুধিগ্রাম অঞ্চল অসিতদার আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত, সেখানেও কেন আমরা হারলাম তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার।’’ রামপুরহাট ২ ব্লকের নেতা চেপে গেলেও রাখঢাক করেননি তৃণমূলের নলহাটি ২ ব্লক সভাপতি বিভাষ অধিকারী। তাঁর দাবি, বিধায়ক দলে নাম লেখানোর আগে অসিতবাবুর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েই এলাকার একটা বড় অংশের কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকেরা তৃণমূলে চলে এসেছিলেন। ‘‘সেই তাঁরাই দেখলেন অসিতবাবুই এ বার তৃণমূলের প্রার্থী। তাঁরা অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে অসিতদাকে ভোট দেননি বলেই আমার মত,”—দাবি বিভাষবাবুর।

অথচ দল না পাল্টানে এ বারও অসিতবাবুর হার কেউ আটকাতে পারত না বলেই দাবি করছেন কংগ্রেসের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকেরা। কিন্তু দলের থেকে নিজের জয় নিয়ে বেশি ভাবতে গিয়েই এই প্রবীণ বিধায়কের ভরাডুবি হল বলে তাঁরা মনে করছেন। একদা অসিতবাবুর গভীর অনুরাগী বলে পরিচিত ছিলেন স্থানীয় বালসা গ্রামের বিশ্বনাথ অধিকারী, বাবলাডাঙা গ্রামের ময়দান শেখরা। তাঁরা বলছেন, ‘‘অসিতদার এই হারের দরকার ছিল। উনি কংগ্রেস ছেড়ে চলে গেলেও আমরা কেউই দল ছাড়িনি। ওঁর সেই বিশ্বাসঘাতকতারই জবাব দিয়েছি মাত্র।’’

প্রায় একই সুর মিল্টনেরও। জয়ের ২৪ ঘণ্টা পরে তাঁর ছোট্ট প্রতিক্রিয়া, ‘‘হাঁসনের মানুষ তাঁদের প্রতি বেইমানির শোধ নিয়েছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Asit Mal Margram surprised vote result
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE