নির্মম: বিদ্যুতের খুঁটিতে বেঁধে চলছে মার। —নিজস্ব চিত্র।
ছেলেধরা নিয়ে ক’দিন ধরেই এলাকায় গুজব ছড়াচ্ছিল। কিন্তু কাউকে যাতে ছেলেধরা সন্দেহে মারধর না করা হয়, সে জন্য পুলিশ বা প্রশাসন প্রচার চালায়নি। তারই খেসারত দিতে হল এক বিএড ছাত্রকে। ছেলেধরা সন্দেহে বছর ছাব্বিশের এক যুবককে বিদ্যুতের খুঁটিতে বেঁধে বেদম মারধর করার অভিযোগ উঠল এলাকার লোকজনের বিরুদ্ধে।
বিষ্ণুপুর শহরে হাঁড়িপাড়ায় সোমবার সন্ধ্যার ঘটনা। রক্তাক্ত অবস্থায় সৌম্যপ্রসাদ দে নামের বিষ্ণুপুরেরই দলমাদল রোডের ওই যুবককে দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, সৌম্যর সিটি স্ক্যান করা হয়েছে। মাথা ও মুখে প্রচুর আঘাত লেগেছে। তবে মঙ্গলবার সকালের দিকে তাঁর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। যদিও ওই ঘটনার পরে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
তদন্তের আশ্বাস দিয়ে পুলিশ সুপার সুখেন্দু হিরা বলেন, ‘‘গ্রামাঞ্চলে ছেলেধরা গুজব নিয়ে আগে প্রচার করা হয়েছে। এখন যখন বিষ্ণুপুর শহরের ভিতরেই এরকম ঘটনা ঘটে গেল, তখন আমরা সব শহরাঞ্চলেই প্রচার করব।’’
অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মী তীর্থপ্রসাদ দে ও বালসি উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষিকা সুধা দে-র একমাত্র সন্তান সৌম্য ওন্দার কাছে একটি বেসরকারি কলেজে বিএড পড়ছেন। তাঁর মামার বাড়ি বিষ্ণুপুর শহরেই ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পোদ্দার পাড়ায়। সোমবার সন্ধ্যায় বাবা-মার সঙ্গে কোনও বিষয়ে কথা কাটাকাটি হওয়ায় সাইকেল নিয়ে তিনি মামার বাড়ি যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েন।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, হাঁড়িপাড়া দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সাইকেলের ধাক্কায় এক শিশুকে ছিটকে পড়ে। সাইকেল থেকে নেমে সৌম্য ওই শিশুটিকে মাটি থেকে তোলে। অভিযোগ, সেই দৃশ্য দেখে এলাকার কিছু লোকজন ছেলেধরা সন্দেহে তার উপরে হামলা চালায়।
স্থানীয় নিউ বুলেট ক্লাবের সামনেই মারধর চলে। ওই ক্লাব সম্পাদক জীতেন সাঁতরা এ দিন বলেন, ‘‘এলাকায় ছেলেধরা বেরিয়েছে বলে কিছুদিন ধরে গুজব চলছিল। শুনেছি, ছেলেটাকে ভরসন্ধ্যায় ওই শিশুকে মাটি থেকে তুলতে দেখে ছেলেধরা ভেবে লোকজন মারধর শুরু করে। বিদ্যুতের খুঁটিতে দড়ি দিয়ে বেঁধে যখন মারধর শুরু করে তখন আমরা বারণ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেউ তা কানে তোলেনি। ভাগ্যিস পুলিশ সময়মতো চলে এসেছিল। না হলে কী হতো কে জানে!’’ বাসিন্দাদের একাংশ জানাচ্ছেন, মারধরের চোটে সৌম্যর মুখ ফেটে গলগল করে রক্ত ঝরছিল। পোশাকও ছিঁড়ে গিয়েছিল। পুলিশ যখন তাঁকে উদ্ধার করে, তিনি কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। পুলিশ বিষ্ণুপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে অবস্থার আরও অবনতি হয়। পাঠানো হয় দুর্গাপুরে।
এ দিনও ঘটনাস্থলে সৌম্যর ছেঁড়া জামার টুকরো পড়েছিল। স্থানীয় প্রবীণদের মধ্যে রাধামোহন সাঁতরা, লুদু সাঁতরা বলেন, ‘‘ছেলেধরা সন্দেহে মারধর করে ঠিক কাজ করেনি। প্রয়োজনে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারত। অপরাধীদের শাস্তি চাই’’
সৌম্যর বাড়িতে ঘটনার পর থেকেই কান্নাকাটি চলছে। মামা তাপস দে, মামাতো বোন রিমা দে অভিযোগ করেন, ‘‘ও তো বাচ্চাটাকে ধাক্কা মেরে চলে যেতে পারতো? সমবেদনা জানানোটা কি অন্যায়? কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে পশুর মতো বেঁধে ওই ভাবে মারবে? হাসপাতালে আমরা গিয়ে দেখি ছেলেটা আধমরা হয়ে পড়ে আছে। দোষীদের অবিলম্বে খুঁজে কঠোর শাস্তি দেওয়া দরকার।’’ তিনিই অভিযোগ দায়ের করেন।
ঘটনার পরে এ দিন অবশ্য এসডিপিও (বিষ্ণুপুর) লাল্টু হালদার টোটোয় চেপে মাইকে ছেলেধরা নিয়ে গুজবে প্ররোচিত না হতে প্রচারে নামেন। তিনি বলেন, ‘‘ওই ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকেও স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলা করা হচ্ছে।’’ কিন্তু এতদিন কেন প্রচারে নামেনি পুলিশ? লাল্টুবাবু দাবি, ‘‘ওই গুজবের কথা আগে শুনিনি।’’ সোমবার রাতে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ কেন অভিযুক্তদের গ্রেফতার করেনি, মেলেনি তার সদুত্তরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy