পুজো-পার্বন হোক বা ক্লাবের অনুষ্ঠান, সাউন্ডবক্স আর মাইকের দাপাদাপিতে কাঁপত মহল্লা। পুলিশের সক্রিয়তায় সেই ছবিটাই বদলাচ্ছিল গত কয়েক মাস ধরে। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে এক অনুষ্ঠান থেকে সাউন্ড সিস্টেম বাজেয়াপ্ত করার পরে বাঁকুড়া থানায় কিছু লোকজন যে তাণ্ডব চালাল এবং তৃণমূলের কয়েকজন নেতাকে যে ভূমিকায় দেখা গেল, তার পরে শব্দ দানবের দাপাদাপি রুখতে পুলিশ কি আর মাঠে নামবে, উঠে গেল সেই প্রশ্ন।
পুজো-পার্বনকে কেন্দ্র করে বাঁকুড়ায় শব্দ দূষণের দাপাদাপি নতুন কিছু নয়। অতিষ্ঠ মানুষজন আগে পালা-পার্বনে তারস্বরে মাইক বাজলে একাধিকবার পুলিশ ও প্রশাসনের দ্বারস্থ হতেন। কিন্তু মাইকের দাপট তাতে কমত না। তবে ছবিটা পাল্টাতে শুরু করেছিল গত এক বছর ধরে। পুলিশেরই কড়া পদক্ষেপের জেরে লাগাম পড়েছিল শব্দ দানবের দাপাদাপিতে। পুলিশের উপর ভরসাও ফিরে আসছিল সাধারণ মানুষের। তবে রবিবার রাতের ঘটনায় ফের ধাক্কা খেল সেই ভরসা।
শহরের গোপীনাথপুর এলাকায় রাত সাড়ে ১০টার সময় তীব্রস্বরে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে নাচাগানার অনুষ্ঠান চলছিল। পুলিশ গিয়ে বক্স বাজানোর মেশিন তুলে নিয়ে আসে থানায়। মদ্যপ অবস্থায় এলাকার কয়েকজন যুবক থানায় গিয়ে বিক্ষোভ দেখায়, ভাঙচুর চালায়। পুলিশ দু’জনকে আটকও করেছিল। কিন্তু মাঝরাতে জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী ও বাঁকুড়া পুরসভার দুই তৃণমূল কাউন্সিলর দেবাশিস লাহা ও অনন্যা চক্রবর্তী থানায় গিয়ে আটক যুবকদের ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। পুলিশও শাসকদলের নেতাদের সামনে টুঁ শব্দ করতে পারেনি। অনন্যাদেবীর সাফাই, “ইমম্যাচিওর ছেলেরা আবেগের বসে থানায় ঝামেলা করে ফেলেছে।” অরূপবাবুর বক্তব্য, “কিছুই হয়নি। সব আষাঢ়ে গল্প ফাঁদা হচ্ছে।” ঘটনার পরদিন দিনভর মুখে কুলুপ এঁটে হাত গুটিয়ে বসেছিল বাঁকুড়া সদর থানার পুলিশ।
প্রায় এক বছর আগে বাঁকুড়া সদর থানার আইসি বিশ্বজিৎ সাহার নেতৃত্বে শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল পুলিশ। লালবাজার এলাকায় একটি সন্তোষী পুজো কমিটির ভাসানে অতিরিক্তমাত্রায় সাউন্ড বক্স বাজানো হচ্ছে দেখে সাউন্ডবক্স বাজেয়াপ্ত করেছিলেন বিশ্বজিৎবাবু। এই ঘটনার জন্য তাঁকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখায় পুজো কমিটির লোকজন। শাসকদলের প্রভাব খাটিয়ে তাঁকে বদলি করে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। তাতে দমে না গিয়ে ঘটনাস্থল থেকেই তৎকালীন পুলিশ সুপার মুকেশ কুমারকে ফোন করে অতিরিক্ত পুলিশ ফোর্স পাঠাতে বলেন বিশ্বজিৎবাবু। ফোর্স আসতেই বিক্ষোভকারী কয়েক জনকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। বাকিরা এদিক ওদিক দৌড় মারে। ঘটনাটি নজর কেড়েছিল এই শহরের অন্যান্য পুজো কমিটিগুলির।
তারপর পার হয়েছে কালীপুজো, সরস্বতী পুজোর মতো বেশ কিছু উৎসব। তাতে অন্যান্য বারের তুলনায় মাইকের দাপাদাপি অনেকটাই কম ছিল বলে মত শহরবাসীর একাংশের। এই লাগাম আরও আঁটোসাটো হবে বলে আশা করেছিলেন শহরবাসী। স্বস্তি পেয়েছিলেন মানুষজন। কিন্তু মাসখানেক পরে মনসা পুজো। এই উৎসবে মাইক, সাউন্ডবক্সের দাপটে কান ঝাঁ ঝাঁ হয়ে ওঠে বাসিন্দাদের। আর সেই উৎসবের আগেই গোপীনাথপুরের ঘটনায় শাসকদলের দাপটের কাছে পুলিশের মুখ থুবড়ে পড়ায় সেই আশা কার্যত অশনি সংকেতে বদলে গিয়েছে।
বাঁকুড়ার বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন আমরা সবাই একসাথে-র সাধারণ সম্পাদক সমীরণ সেনগুপ্তের কথায়, “লালবাজারের ঘটনার পরে বেআইনি মাইক ব্যবহার রুখতে পুলিশের ভূমিকা ছিল সদর্থক। শহরে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। কিন্তু গোপীনাথপুরের ঘটনায় শাসক দলের প্রভাবে পুলিশ ফের অবস্থান বদল করছে বলেই ইঙ্গিত মিলছে। এতে আমরা সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে চিন্তিত।” বাঁকুড়া সারদামনি গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ গুপ্ত বলেন, “বেআইনি মাইক ব্যবহার বন্ধ করতে ক্লাবস্তর থেকে সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার। এই কাজে নামতে হবে সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক মানুষজনকে।’’
তবে রবিবার রাতের ঘটনায় পুলিশের উপর থেকে মানুষের আস্থা উঠে যাওয়ার কোনও কারণ দেখছেন না জেলা পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার। পাশাপাশি ‘তৃণমূলের প্রভাবে’ পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বলে যে অভিযোগ উঠছে তাও মানতে নারাজ তিনি। তাঁর কথায়, “পুলিশ নিজের মতো কাজ করেছে। আগামী দিনেও করবে। কারও প্ররোচনায় পুলিশ চলে না। ঘটনার প্রেক্ষিতে যা ব্যবস্থা নেওয়ার ছিল তা নেওয়া হয়েছে।”
রবিবার রাতের ঘটনায় জড়িত দলীয় নেতা নেত্রীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে তৃণমূলের রাজ্য নেতৃত্ব। জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী দলের ভৎর্সনার মুখে পড়েছেন। শাসক দলের জেলা সভাপতি অরূপ খাঁ জানিয়েছিলেন, কাউন্সিলর অনন্যা চক্রবর্তীকে শো-কজ করা হবে। কিন্তু তাঁকে আদৌ কারণ দর্শানোর নোটিস পাঠানো হয়েছে কি না তা জানা যায়নি। সভাপতি অরূপবাবু এ দিন বিধানসভায় ব্যস্ত ছিলেন। অন্যন্যাদেবী বলেন, “এ বিষয়ে কিছু বলব না।” তবে ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরেও নিজের বক্তব্যে অনড় রয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “যাঁরা রবিবার রাতে থানায় বিক্ষোভ দেখিয়েছিল তাঁরা বয়সে ছোট। তাই ইমম্যাচিওর বলেছি।” তা এই ইমম্যাচিওর ছেলেদের অন্যায় দাবির সমর্থনে থানায় গিয়ে গলা ফাটালেন কেন? “এ ব্যাপারে কিচ্ছু বলব না”—সাফ কথা নবাগত কাউন্সিলরের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy