Advertisement
১৭ মে ২০২৪

আলুতে নাবিধসা রুখতে জলদি চাষ

আলু, অর্থকরী এই ফসলের চাষ পশ্চিমবঙ্গে প্রায় প্রতি বছর নাবিধসা রোগের কারণে কম- বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উৎপাদন কমায় আলুর চাহিদা বাড়ে। সঙ্গে বাড়ে দাম। তখন বাজারে আলু কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস ওঠে গৃহস্থেরও। সমস্যা এড়াতে জরুরি কিছু ব্যবস্থা নেওয়া, সতর্ক থাকাআলু, অর্থকরী এই ফসলের চাষ পশ্চিমবঙ্গে প্রায় প্রতি বছর নাবিধসা রোগের কারণে কম- বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উৎপাদন কমায় আলুর চাহিদা বাড়ে। সঙ্গে বাড়ে দাম। তখন বাজারে আলু কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস ওঠে গৃহস্থেরও। সমস্যা এড়াতে জরুরি কিছু ব্যবস্থা নেওয়া, সতর্ক থাকা।

কৌশিক ব্রহ্মচারী
শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৫২
Share: Save:

বীজ বসানোর সময়

লক্ষ্য করে দেখা গিয়েছে, প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে নাবিধসা রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হয়। এই সময় ঘন কুয়াশা, আশি শতাংশের বেশি আপেক্ষিক আর্দ্রতা, সাত ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা, মেঘাচ্ছন্ন ও ঝিরঝিরে বৃষ্টিবহুল আবহাওয়ায় এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। দেরিতে বোনা আলুতে ক্ষতির মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এই সব দিক মাথায় রেখে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ কার্তিক মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে আলুবীজ বসাতে হবে। এটা হিসাবে রাখতে হবে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ পৌষের তৃতীয় সপ্তাহে গাছের বয়স যেন ৭০-৭৫ দিন হয়ে যায়।

বীজ ও জাত নির্বাচন

• নীরোগ বীজ সংগ্রহ করা খুব জরুরি। যাতে বীজের মাধ্যমে কোনও রোগ জমিতে না যায়। এই জন্য নির্দিষ্ট জাতের ‘সার্টিফায়েড বীজ’ সরকার স্বীকৃত বীজ বিক্রেতার কাছ থেকে কিনতে হবে। বীজ কেনার সময় সার্টিফায়েড কার্ড দেখে নিতে হবে ও রসিদ নিতে হবে। রসিদে যেন ‘বীজ আলু’ কথাটা লেখা থাকে।

• বাড়িতে রাখা বীজ বসাতে হলে অপেক্ষাকৃত কম ধসা লেগেছিল এমন জমির বীজ অথবা গত বছর ৭০-৭৫ দিন বাদে ধসা এসেছিল এমন জমির বীজ ব্যবহার করা যেতে পারে।

• কোল্ড স্টোরেজে পাঠানোর আগে যে সব আলুর বীজ ভাল ভাবে ঝাড়াই বাছাই করে ৩% বোরিক অ্যাসিড দ্রবণে শোধন করা হয়েছিল, সেই সব বীজ ব্যবহার করতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়।

• সন্দেহজনক দাগবাহী আলু বাদ দেওয়া উচিত। বীজ হিসাবে গোটা আলু লাগানোই ভাল। বড় আলু হলে কেটে লাগালে চলবে, তবে প্রতি টুকরোয় যেন দু’টো চোখ থাকে। আর ওজন হওয়া দরকার ২৫-৩০ গ্রাম। কাটার সময় আলুর ভিতর কোনও দাগ দেখলে তা বাদ দিতে হবে।

• ৭০-৮০ দিনের জলদি জাত হল কুফরি চন্দ্রমুখী ও কুফরি অলঙ্কার, ৯০-১০০ দিনের মাঝারি জাত হল কুফরি জ্যোতি ও কুফরি সিন্দুরী। ১০০-১২০ দিনের নাবি জাত হল কুফরি বাদশা, কুফরি লালিমা, পিজে ৩৭৬ ইত্যাদি। এছাড়া জনপ্রিয় পোখরাজ। চিপসের জন্য চিপসোনা ১ ও ২, আটলান্টিকা চাষ হচ্ছে এখন।

বীজশোধন

• মাটির পাতনায় অথবা প্লাস্টিকের গামলায় ৫০ লিটার জলে ১০০ গ্রাম মিথক্সি ইথাইল মারকিউরিক ক্লোরাইড (এমইএমসি) ৬% গুলে নিয়ে তাতে ১০০ কেজি বীজ মিনিট দু’য়েক চুবিয়ে একটু নাড়াচড়া করে শুকিয়ে নিতে হবে ছায়ায়। তারপরে এই বীজ লাগাতে হবে জমিতে। ৩-৪ বার ব্যবহার করা যেতে পারে এই দ্রবণ। তারপরে তা পাল্টাতে হবে। ম্যানকোজেব ৭৫% বা কার্বাক্সিন ৩৭.৫% + থাইরাম ৩৭.৫% লিটার প্রতি জলে ২-৩ গ্রাম হারে গুলে তার মধ্যে বীজ আলু ৫-১০ মিনিট চুবিয়েও শোধন করা চলে। বীজশোধনে ব্যবহার করা যেতে পারে ট্রাইকোডার্মা হারজিয়ানাম বা সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স প্রজাতির জীবাণু (মাত্রা লিটার প্রতি জলে ৫-১০ গ্রাম)

• বড় আলু কেটে ছোট করে নেওয়ার সময় বঁটি পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণে শোধন করুন। কোনও সময় রোগাক্রান্ত আলু কেটে ফেললে ওই দ্রবণে ভেজানো কাপড় দিয়ে বঁটি মুছে নিন।

জমি তৈরি

•আলুর আগে স্বল্পমেয়াদি ধানের চাষ করে থাকলে আশ্বিন মাসের শেষেই জমি খালি করা দরকার। কার্তিকের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে গভীর চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করুন।

•জমি চাষের সময় বিঘা প্রতি ৭-৮ গাড়ি গোবর সার বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করা দরকার। বিঘা প্রতি একশো কেজি গোবর সারের সঙ্গে এক কেজি ট্রাইকোডার্মা হারজিয়ানাম ও এক কেজি সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স দেওয়া যেতে পারে। তবে জীবাণু সার মেশানোর পর ৬-৭ দিন ছায়ায় রেখে সেই জৈব সার মাটিতে মেশাতে হবে। এছাড়াও এই সময় বিঘা প্রতি ৬০০ গ্রাম অ্যাজোটোব্যাক্টর, ৬০০ গ্রাম অ্যাজোস্পাইরিলাম ও ৬০০ গ্রাম ফসফোব্যাক্টর জৈবসারের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

•জমিতে কাটুই পোকা, ঘুরঘুরে পোকা বা উই থাকলে শেষ চাষের সময় বিঘা প্রতি চার কেজি হারে দানাদার কীটনাশক প্রয়োগ করুন।

বীজবপন

• বসানোর সময় আলুর চোখ উপরের দিকে না রেখে পাশে রাখুন—শিকড় ও কাণ্ড সংখ্যা বাড়বে তাতে।

• প্রয়োজনীয় সার মাটিতে দেওয়ার দু’তিন দিন বাদে বীজ বসান। তাতে সারের কার্যকারিতা বাড়বে।

• ভেলি থেকে ভেলির দূরত্ব রাখুন দেড় থেকে দু’ফুট। আর ভেলিতে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব রাখুন ৬ ইঞ্চি। নালায় আলুর উপর ৩"-৪" মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া জরুরি।

• ২৫-৩০ গ্রাম ওজনের বা ২.৫ থেকে ৫ সেমি ব্যাসযুক্ত আলুর ক্ষেত্রে বীজের হার বিঘা প্রতি দুই থেকে আড়াই কুইন্টাল।

সার প্রয়োগ

• মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতেই সার প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়। অম্ল মাটিতে চুন বা ডলোমাইট প্রয়োগ করতে হবে আলু বসানোর অন্তত ২১ দিন আগে।

• বিঘা প্রতি নাইট্রোজেন সারের মাত্রা ৪৫ কেজি ইউরিয়া অথবা ৮০ কেজি ক্যালসিয়াম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট অথবা ১০০ কেজি অ্যামোনিয়াম সালফেট। সঙ্গে দিতে হবে ১০৫ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসপেট ও ২৮ কেজির মতো মিউরিয়েট অফ পটাশ।

• যাঁরা ডিএপি সার ব্যবহার করতে চান, তাঁরা ৩৬ কেজি ডিএপি-র সঙ্গে দিন ৩০ কেজি ইউরিয়া ও ২৮ কেজি মিউরিয়েট অফ পটাশ।

• এছাড়া ৩-৪ সপ্তাহের মাথায় প্রথম ভেলি তোলার সময় চাপান সার হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে ১৫ কেজি ইউরিয়া বা ২৬ কেজি ক্যালসিয়াম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট অথবা ৩৩ কেজি অ্যামোনিয়াম সালফেট।

• খেয়াল রাখবেন, ধসা লাগা জমিতে নাইট্রোজেন চাপান সার বন্ধ রাখতে হবে রোগ উপশম পর্যন্ত। ধসা লাগলে কৃষি বিষ প্রয়োগ দ্বারা রোগ নিয়ন্ত্রণ করে তবেই সেচ দেওয়া উচিত। প্রথমে ভেলির ১/৩ ভাগ এবং পরের দিকে ২/৩ ভাগ ডুবিয়ে সেচ দিতে হয়। আলু তোলার ১০-১২ দিন আগেই সেচ বন্ধ করে দিতে হবে।

অন্তর্বর্তী পরিচর্যা

• ভেলি বানানোর সময়েই আগাছা দমন করতে হবে। প্রয়োজনে পরিবেশ বান্ধব আগাছা নাশক ব্যবহার করা যায়।

• জমিতে জলদি বা নাবি ধসা বা অন্য ছত্রাকজনিত রোগ এরপরেও দেখা দিতে পারে। এই কারণে ভেলি তোলার পরে পরেই একবার ছত্রাকনাশক স্প্রে করা প্রয়োজন। কপার অক্সিক্লোরাইড ৫০% (এক লিটার জলে ৪ গ্রাম), ম্যানকোজেব (এক লিটার জলে ২.৫ গ্রাম), মেটাল্যাকসিল ৮% ও ম্যানকোজেব ৬৪%-এর মিশ্রণ (এক লিটার জলে ২.৫ গ্রাম) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে কোনও ছত্রাকনাশকই বারবার একনাগাড়ে ব্যবহার করা ঠিক নয়।

• মেঘলা আবহাওয়ায় ধসার ন্যূনতম উপস্থিতি দেখলে শুরুতেই ব্যবস্থা নিতে হবে। জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় জাবপোকা দেখা দিলে ইমিডাক্লোপ্রিড বা মিথাইল ডেমিটন গোত্রের ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।

শেষবেলা

• আলু ৭০-৭৫ দিন বয়সে পৌঁছলে গাছের সবুজ ডাঁটা কেটে দিতে হবে। জাবপোকাবাহিত ভাইরাসের হাত থেকে মুক্তি পেতে কাটা অংশে স্প্রে করতে হবে ছত্রাকনাশক। ডাঁটা কাটার ১০-১৫ দিন বাদে ফসল তোলা উচিত।

• এই সময় সেচ দেবেন না। এটা খোসা শক্ত হওয়ার সময়।

• মাটি থেকে সাবধানে আলু তুলে ৮-১০ দিন স্তূপ করে রেখে তার থেকে ঝাড়াই-বাছাই করা বীজ ৩% বোরিক অ্যাসিডে ডুবিয়ে তবেই পাঠাতে হবে হিমঘরে।

• লেখক বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

potato farmer farmer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE