একে নিম্নচাপ অক্ষরেখা-ঘূর্ণাবর্তের ঠেলায় পরিত্রাহি। তার উপরে দোসর জুটেছে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা। দুইয়ে মিলে চলতি মরসুমের গোড়া থেকে দক্ষিণবঙ্গে শীতের বারোটা বাজিয়ে এসেছে। তাদের চোখরাঙানি এমন পর্যায়ে যে, আজ আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসল শীত পড়ার সম্ভাবনা থাকলেও তার স্থায়িত্ব সম্পর্কে গ্যারান্টি দিতে পারছেন না আবহবিদেরা।
ডিসেম্বর পড়তে না পড়তেই কাশ্মীর থেকে আসা পশ্চিমী ঝঞ্ঝা অন্যান্য জায়গার মতো দক্ষিণবঙ্গে হানা দিয়েছে। সাময়িক ভাবে মেঘ ঢোকালেও পশ্চিমী ঝঞ্ঝা আদতে শীতের বাহক। কারণ, ঝঞ্ঝা বিদায় নিলে আকাশ পরিষ্কার হয়ে উত্তুরে হাওয়া ঢুকে শীতের পথ খুলে দেয়। তবে এ বার সে নিয়মে বাদ সেধেছে নিম্নচাপ-অক্ষরেখা ও ঘূর্ণাবর্তের ঢল। যাদের দৌলতে তামাম প্রাকৃতিক পরিস্থিতিটাই বেবাক বদলে গিয়েছে।
আবহবিদেরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশ বা ওড়িশা উপকূলে গজিয়ে ওঠা একের পর এক ঘূর্ণাবর্ত, নিম্নচাপ-অক্ষরেখার জেরে মধ্য ভারতে তৈরি হচ্ছে উচ্চচাপ বলয়। পশ্চিমী ঝঞ্ঝা সেখানে ঢুকে নতুন নতুন নিম্নচাপ-অক্ষরেখা বানিয়ে ফেলছে। সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ায় গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের শীত-ভাগ্যে মন্দা। এখানে বঙ্গোপসাগর থেকে
মেঘ ঢুকছে হু-হু করে, অথচ তা কাটার নাম নেই। সূর্য অদৃশ্য, মাঝে-মধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে।
এবং মেঘাচ্ছন্ন আকাশে আটকে যাচ্ছে শীতের রথ। আলিপুর হাওয়া অফিসের হিসেবে, ২ ডিসেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ-ওড়িশা-মধ্যপ্রদেশ-ছত্তীসগঢ় ও উপকূলবর্তী পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে মোট আটটি ঘূর্ণাবর্ত ও নিম্নচাপ অক্ষরেখা তৈরি হয়েছে, যা নিতান্ত অস্বাভাবিক। বস্তুত এ মাসের প্রথম আঠারো দিনের সাত দিন একটি বারের জন্যও সূর্যের দেখা মেলেনি। ছ’দিন সূর্যোদয় হয়েছে সকাল আটটার পরে। আর পাঁচ দিন বিকেল চারটের পরে সূর্য মুখ লুকিয়েছে। ‘‘কড়া রোদ থাকলে তবেই না-জাঁকিয়ে শীত পড়বে!
এমন হলে শীতের কী দোষ?— মন্তব্য এক আবহবিদের।
এ দিকে শুক্রবার ভোরের বৃষ্টিতে কলকাতা জবুথবু। মাঙ্কিক্যাপ, স্কার্ফ, পুলওভার, জ্যাকেট— মওকা পেয়ে আলমারি থেকে বেরিয়ে এসেছে হুড়মুড়িয়ে। লন্ডন, দার্জিলিঙের সঙ্গে কলকাতার তুলনা চলছে মুখে-মুখে। যদিও হাওয়া অফিসের লোকজন অত উৎসাহিত নন। তাঁদের বক্তব্য, এটা আদৌ শীত নয়। আসল শীত পড়েছিল বৃহস্পতিবার, যে দিন শহরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নেমেছিল ১৪ ডিগ্রির (এ সময়ের স্বাভাবিক) কাছাকাছি। সে জায়গায় শুক্রবারের সর্বনিম্ন ১৭ ডিগ্রির উপরে। মানে স্বাভাবিকের তিন ডিগ্রি বেশি। তাই আবহবিজ্ঞানীরা একে শীত বলতে নারাজ।
কিন্তু এই যে মানুষ হি-হি করে কাঁপছেন, সেটা শীত নয়তো কী?
আবহবিদদের দাবি, এটা হল শীত-শীত ভাব। কেন্দ্রীয় আবহবিজ্ঞান মন্ত্রকের পূর্বাঞ্চলীয় ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথের কথায়, ‘‘বছরের এই সময়টায় সূর্য না-উঠলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা তেমন বাড়তে পারে না। ফলে একটা ঠান্ডা ভাব মালুম হয়। আমরা বলি কোল্ড ডে।’’ কলকাতার শুক্রবার ছিল সে রকমই এক শীতার্ত দিন। ‘‘এ সময়ে রাতে আবার অস্বস্তি হয়। কারণ, পরিমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের চাপে তাপমাত্রা সে ভাবে নামতে পারে না।’’— মন্তব্য গোকুলবাবুর। উত্তরবঙ্গে শীতকালে এমনটা হামেশা হলেও কলকাতায় খুব একটা চেনা ব্যাপার নয়।
ছবিটা এ ভাবে বদলে যাওয়ার পিছনে জলবায়ু পরিবর্তনের ছায়াও দেখছেন আবহবিদদের একাংশ। পুণের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া পূর্বাভাস দফতরের এক বিজ্ঞানীর পর্যবেক্ষণ, ‘‘এটা এল নিনোর বছর। আবহাওয়ার বহু পরিবর্তন দেখা গেল। আগামী বছরও এল নিনো শক্তিশালী থাকবে। তাই ধরে নেওয়া যায়, ভেল্কিবাজি আগামী বছরেও চলবে।’’ প্রসঙ্গত, উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর দাপটে নভেম্বর-ডিসেম্বরে চেন্নাইয়ে যে বিধ্বংসী বৃষ্টি হয়ে গেল, তার দায়ও এল নিনোর ঘাড়ে চাপিয়েছেন আবহবিদদের বড় অংশ।
আলিপুর অবশ্য এ দিন কিঞ্চিৎ আশার বার্তাও শুনিয়েছে। তাদের পূর্বাভাস— আজ, শনিবার থেকে দক্ষিণবঙ্গের আকাশ পরিষ্কার হয়ে প্রকৃত শীতের অনুকূল পরিবেশ দেখা দিতে পারে। দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হ্রাসের সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকী, রবিবার মহানগরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রির নীচে নেমে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন গোকুলবাবু।
কিন্তু আবার কোনও নিম্নচাপ বা ঘূর্ণাবর্ত এসে ফ্যাসাদ বাধাবে না তো?
উপগ্রহ-চিত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে থমকে গেলেন হাওয়া-কর্তা। বঙ্গোপসাগরে একটা নিম্নচাপ তৈরির ইঙ্গিত দেখে কম্পিউটারে কিছুক্ষণ হিসেব-নিকেশ করলেন। বললেন, ‘‘দক্ষিণবঙ্গের শীতে ওই নিম্নচাপ বোধহয় দাঁত ফোটাতে পারবে না। দেখা যাক, শেষমেশ কী দাঁড়ায়।’’
অর্থাৎ শীতের আগমনী শোনা গেলেও বুক ঠুকে বলা যাচ্ছে না, সে থিতু হবে ক’দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy