Advertisement
১৭ মে ২০২৪
Bangladesh Liberation War

শিকড়ের খোঁজে ‘বীরাঙ্গনা’র মেয়ে

ইতিহাসবিদদের অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘বীরাঙ্গনা’ শিরোপাটির মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে এক রক্তঝরা ইতিহাস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ।

An image of Adoption

—প্রতীকী চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৩ ০৮:৪১
Share: Save:

নিজের পরিচয় খুঁজছেন জেন রাডিকা। আর খুঁজছেন নিজের মাকে। ১৯৭২ সালের এক গ্রীষ্মে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ বয়সে ঢাকা থেকে ব্রিটেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জেনকে। সে দেশের এক ছোট্ট শহরে মাইক কিং ও তাঁর স্ত্রীর যত্নে বড় হতে থাকেন তিনি। নিজেকে বুঝতে শেখার পর থেকেই অবশ্য জেনকে বার বার পিছু ডেকেছে তাঁর অতীত। ডাক এড়াতে পারেননি, শুরু করেছেন অন্বেষণ। ব্রিটেনের এক স‌ংবাদপত্রে এই নিয়ে প্রকাশিত
হয়েছে তাঁর সাক্ষাৎকার। জেন জেনেছেন, তাঁর মতো আরও মানুষ ছড়িয়ে রয়েছেন সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও কানাডার মতো বিদেশ-বিভুঁইয়ে। যাঁরা সকলেই ‘বীরাঙ্গনা’র সন্তান।

ইতিহাসবিদদের অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘বীরাঙ্গনা’ শিরোপাটির মধ্যে জড়িয়ে রয়েছে এক রক্তঝরা ইতিহাস। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ। ব্রিটিশ সংবাদপত্রটির বিবরণ অনুযায়ী, তার ঠিক আগের ন’মাস ধরে ঢাকা, খুলনা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল-সহ বহু জেলা দিয়ে বয়ে গিয়েছে রক্তস্রোত। প্রতিবেদনে দাবি, অন্তত তিন লক্ষ মানুষ খুন হয়েছিলেন পাকিস্তানি সেনার হাতে। সেই সঙ্গে নির্বিচারে ধর্ষণ। বিশেষজ্ঞ ও সংবাদপত্রটির মতে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণ ও যৌন হেনস্থাকে কার্যত অস্ত্র করে তুলেছিল পাক সেনা। সংবাদপত্রটিতে দাবি, কম করে দু’লক্ষ নারী ধর্ষিতা হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকে প্রাণ হারিয়েছিলেন, অনেকের গর্ভে ছিল সন্তান। তথ্য মেলে এমন প্রায় ২৫ হাজার গর্ভধারণের।

যুদ্ধ শেষ হল। স্বাধীন হল দেশ। কিন্তু এই মহিলাদের কী হবে? শেখ মুজিবুর রহমান এঁদের ‘বীরাঙ্গনা’ সম্মানে ভূষিত করলেন। আর অনাথ শিশুদের দায়িত্ব নিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রক। তাদের দত্তকের জন্য আন্তর্জাতিক একটি প্রচারও শুরু হল। ব্রিটেনের সংবাদপত্রটি জানিয়েছে, সেই সূত্রেই মাইক কিং বুকে তুলে নিয়েছিলেন জেনকে। ১৯৭২ সালে প্রথম যে শিশুদের দত্তক নেওয়া হয়, জেন ছিলেন তাদেরই একজন।

সংবাদপত্রকে জেন জানিয়েছেন, ‘আমি শুধু জানি, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমার মা ধর্ষিতা হয়েছিলেন। একটা সময়ে ভাবতাম, যবে থেকে আমায় দত্তক নেওয়া হয়, তবে থেকেই আমার জীবন শুরু। এখন জানি সেটা ভুল। বাংলাদেশেও আমার জীবনের অংশ রয়েছে।’ বাংলাদেশের যে অনাথ আশ্রম থেকে তাঁকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল, সেখানকার খাতায় তাঁর নাম হিসেবে রাডিকা লেখা থাকলেও, তাঁর মায়ের নাম নেই। বাড়ির ঠিকানা হিসেবে স্রেফ লেখা, ‘উইমেন রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম’। জেনের আফসোস, কখনওই হয়তো জন্মদাত্রীকে খুঁজে পাবেন না তিনি।

সংবাদপত্রটি জানিয়েছে, যুদ্ধের পরে অন্তত পাঁচ হাজার শিশুর জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশে। অনাথ আশ্রমের প্রতিনিধিরা সেই সময়ে শহরের রাস্তা থেকে তুলে এনেছেন বহু সদ্যোজাতকে। বহু গর্ভপাতের ক্লিনিকে গিয়ে মায়েদের অনুরোধ করেছেন সন্তানের জন্ম দিয়ে তাঁদের হাতে তুলে দিতে। অনেক মায়ের গর্ভপাতের সংস্থান না থাকায় নিজে নিজে গর্ভপাতের চেষ্টা করতেন। ফলে প্রাণহানিও হয়েছে বহু। শিখা কাপুচিনোর গল্পটাই যেমন খানিকটা এ রকম। গর্ভপাতের ব্যর্থ চেষ্টার পরে সাত মাসে জন্ম হয় শিখার। মায়ের পরিচয় তিনি জানেন না এখনও। ঢাকার অনাথ আশ্রম থেকে তাঁকে দত্তক নেন কানাডার ফ্রেড ও বনি কাপুচিনো।

দু’বছর আগে নিজের মায়ের খোঁজ শুরু করেছিলেন জেন। সংবাদপত্র থেকে জানা গিয়েছে, তিনি সেই খোঁজ থেকেই পৌঁছন তেজগাঁওয়ে। যেখানে কয়েক জন ‘বীরাঙ্গনা’র বাড়ি। সন্তানস্নেহে জেনকে বুকে টেনে নিয়েছেন তাঁরা। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরে এই দৃশ্য মনে করায় একটি বিশেষ ওয়েবসিরিজ়ের কথা। যেখানে কারাগারের আখরে রচিত
হয় ইতিহাস।

জেনের কথায়, “ওঁদের মধ্যে আমার মায়ের ছোঁয়া রয়েছে।” আরও বলেন, “বাংলাদেশ ও আমি প্রায় একই সময়ে তৈরি হয়েছি। এই সত্যের কখনও পরিবর্তন হবে না।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE