১। জন্ম এক সাধারণ তন্তুবায় পরিবারে। সেখান থেকে নিজের কর্মদক্ষতায় পরিণত হয়েছিলেন বিত্তবান ব্যবসায়ীতে। আজ, উত্তর কলকাতার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ অংশের নামকরণের পিছনে রয়েছে তাঁরই নাম। কিন্তু শোভারাম বসাক সম্বন্ধে ঐতিহাসিক বা প্রামাণ্য তথ্য রয়েছে খুবই কম।
২। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম মুর্শিদাবাদে। তখন অবশ্য গঙ্গার তীরে এই জনপদের নাম ছিল মকসুদাবাদ। পরে বসাক পরিবার তাঁদের ভদ্রাসন ছেড়ে চলে যান হুগলির সপ্তগ্রামে।
৩। ব্রিটিশদের সঙ্গে সুতো ও কাপড়ের কারবার শুরু করেন শোভারাম। দক্ষতা ও অধ্যবসায়ের জেরে তাঁর বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভ হতে দেরি হয়নি। দূরদর্শী শোভারাম ব্যবসায়ে আরও উন্নতির জন্য সপ্তগ্রামের বাস উঠিয়ে চলে আসেন গোবিন্দপুরে।
৪। অষ্টাদশ শতকে গোবিন্দপুর, সুতানটী ও কলকাতা, এই তিন জনপদের মধ্যে প্রথমটিতেই থাকতেন শ্রেষ্ঠীরা। পরে ব্রিটিশরা তাদের দুর্গের (ফোর্ট উইলিয়াম) জন্য গোবিন্দপুরকে পছন্দ করে। তাদের দুর্গের জন্য জমি দিতে শোভারাম সপরিবারে উঠে যান বড়বাজারে।
৫। বড়বাজারে তাঁর নতুন বসতবাড়ির উল্টোদিকের রাস্তাটির নাম হয় শোভারাম বসাক স্ট্রিট। নতুন বাড়ির পশ্চিম দিকে গঙ্গাতীরে মন্দির তৈরি করে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। জগন্নাথদেব ছিলেন তাঁর পারিবারিক আরাধ্য দেবতা। পরে ওই দেবালয় থেকে ঘাটের নামকরণ হয় ‘জগন্নাথ ঘাট’।
৬। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হন শোভারাম। কিন্তু কলকাতার সঙ্গে তিনি এবং তাঁর সময় মিলেমিশে গিয়েছে বরাবরের মতো। এখন যেখানে শোভাবাজার রাজবাড়ি, তার পূর্ব দিকে শোভারাম বসাকের একটি বাগান এবং চাষের জমি ছিল। সেই জমিতে যা ফলত, সে সব বিক্রি হত স্থানীয় এলাকাতেই। ক্রমে পুরো এলাকারই নাম হয়ে যায় শোভাবাজার।
৭। সে সময় শোভাবাজার ছিল কাপড়ের ব্যবসার জন্য সুপ্রসিদ্ধ। ব্যবসার অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন শোভারাম বসাক। উত্তর কলকাতার আর এক বিখ্যাত বাজার ‘শ্যামবাজার’-এর নামকরণেও তাঁর অবদান আছে।
৮। বলা হয়, বৈষ্ণব ব্যবসায়ী শোভারাম গোপল জীউ এবং শ্যামচাঁদ ঠাকুর রূপেও কৃষ্ণের সেবা করতেন। তাঁর আরাধ্য দেবতার নামেই নামকরণ হয় ‘শ্যামবাজার’। পরে ব্রিটিশরা এর নতুন নাম রাখেন ‘চার্লস বাজার’। কিন্তু ব্রিটিশদের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে সে নাম পাল্টাতেও শোভারামের সমস্যা হয়নি।
৯। চার্লস বাজার আবার ‘শ্যামবাজার’ হয়ে যায়। তবে এ বার শোভারামের অনুরোধে তাঁর আত্মীয় শ্যামচাঁদ বসাকের নামে নামকরণ হয় ‘শ্যামবাজার’ এবং ‘শ্যামপুকুর’-এর।
১০। তবে খ্যাতির পাশাপাশি বিতর্কের ভাগীদারও হতে হয়েছে তাঁকে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিরাজদৌল্লার হাত থেকে কলকাতাকে আবার উদ্ধার করে ব্রিটিশ বাহিনী। পলাশির যুদ্ধের পরে মীরজাফরকে পুতুল-নবাব বানিয়ে হিসেবহীন অর্থ আদায় করত ব্রিটিশরা। শোনা যায়, দেশীয় প্রজাদের ক্ষতিপূরণের জন্য মোট ৩০ লক্ষ টাকা এসেছিল মীরজাফরের কোষাগার থেকে।
১১। তার মধ্যে ১০ লক্ষ টাকা বণ্টন করার জন্য ১৩ জন হিন্দু কমিশনারকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে এক জন ছিলেন শোভারাম বসাক। পরে অবশ্য এই কমিশনারদের বিরুদ্ধে অর্থের সুষম বণ্টন না করার অভিযোগ ওঠে। ব্রিটিশ সরকারের কাছে অভিযোগ জানান ক্ষতিগ্রস্ত প্রজারা।
১২। তদন্তে গাফিলতি প্রমাণিত হয়। এবং শোনা যায়, শোভারাম বসাক নাকি স্বীকারও করেছিলেন তিনি ক্ষতিপূরণের সব টাকা বণ্টন করেননি। যদিও ব্রিটিশদের সঙ্গে সখ্যের সুবাদে তাঁকে কোনও দুর্ভোগের শিকার হতে হয়নি।