শেয়ার বাজারে শোরগোল! হু-হু করে পড়ছে বৈদ্যুতিন বাইক-স্কুটার নির্মাণকারী সংস্থা ওলা ইলেকট্রিকের স্টকের দর। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো সম্প্রতি এর শেয়ার বিক্রি করেছেন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা তথা চিফ এগ্জ়িকিউটিভ অফিসার (সিইও) ভবেশ আগরওয়াল। এই ঘটনা লগ্নিকারীদের মনে যে আতঙ্ক তৈরি করেছে, তা বলাই বাহুল্য। ওলা ইলেকট্রিকের দিন কি তবে ফুরোতে চলেছে? ইতিমধ্যেই সেই প্রশ্নের জবাব খোঁজা শুরু করেছে আর্থিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে একাধিক ব্রোকারেজ ফার্ম।
ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের (এনএসই) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বার নিজের হাতে থাকা স্টক বিক্রি করেন ওলা ইলেকট্রিকের প্রতিষ্ঠাতা তথা সিইও ভবেশ। ওই দিন ২.৬৩ কোটি শেয়ার ছেড়ে দিয়ে ৯১.৮৭ কোটি টাকা পান তিনি। ১৭ ডিসেম্বর ফের স্টক বিক্রি করতে দেখা যায় তাঁকে। এ বার ৪.১৯ কোটি শেয়ার বাজারে ছেড়ে দেন তিনি। তাঁর হাতে থাকা স্টক গড়ে বিক্রি হয় ৩৩.৯৬ টাকায়। এই লেনদেনে ভবেশের পকেটে আসে ১৪২ কোটি টাকা।
এর পর ১৮ ডিসেম্বর আরও শেয়ার বিক্রি করেন বৈদ্যুতিন বাইক-স্কুটার নির্মাণকারী সংস্থাটির সিইও। তৃতীয় দিনে ২.৮৩ কোটি শেয়ার ছেড়ে দেন তিনি। এর প্রতিটির গড়ে দাম ছিল ৩১.৯০ টাকা। এতে প্রায় ৯০.৩ কোটি টাকা পান ভবেশ। পর পর তিন দিন সংস্থার মালিককে এ ভাবে স্টক বিক্রি করতে দেখে স্বাভাবিক ভাবেই লগ্নিকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এর জেরে দ্রুত শেয়ার ছেড়ে দিতে শুরু করেন তাঁরা। ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে থাকে দামের সূচক।
উদাহরণ হিসাবে গত ১৮ তারিখের কথা বলা যেতে পারে। ওই দিন বাজার খোলার কিছু ক্ষণের মধ্যেই তিন শতাংশ কমে প্রথমে ওলা ইলেকট্রিকের স্টক চলে আসে ৩২.২২ টাকায়। ওই তারিখে দিনের মধ্যে সর্বনিম্ন ৩১.৫৬ টাকায় নেমে যায় দর, যেটা ৫২ সপ্তাহের সর্বনিম্ন স্তরের কাছাকাছি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ন’মাস আগেও এক বার মারাত্মক ভাবে কমেছিল ওলা ইলেকট্রিকের শেয়ারের দাম। ওই সময় বৈদ্যুতিন বাইক-স্কুটার নির্মাণকারী সংস্থাটির স্টকের সূচকে আট শতাংশের পতন দেখা গিয়েছিল।
ওলা ইলেকট্রিকের ৩০.০২ শতাংশ স্টক রয়েছে প্রতিষ্ঠাতা তথা সিইও ভবেশের কাছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির প্রোমোটারদের তালিকায় নাম আছে জাপানের সফটব্যাঙ্ক, টাইগার গ্লোবাল এবং ওলা কনজ়্যুমারের। তাদের হাতে থাকা শেয়ারের পরিমাণ যথাক্রমে ১৭.৮৩ শতাংশ, ৪.৯০ শতাংশ এবং ৩.৬৪ শতাংশ। এদের মধ্যে কিছু দিন আগে বৈদ্যুতিন বাইক-স্কুটার নির্মাণকারী সংস্থাটির স্টক বিক্রি করে সফটব্যাঙ্ক। ওলা ইলেকট্রিকের শেয়ারের খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য এই ঘটনাকেও দায়ী করেছেন বিশ্লেষকেরা।
২০১৭ সালে ভবেশের হাত ধরে ভারতের বাজারে পথচলা শুরু করে ওলা। গোড়ার দিকে এটি ছিল কেবলমাত্র একটি অ্যাপ-ক্যাব সংস্থা। পরবর্তী কালে কর্নাটকের বেঙ্গালুরুতে ই-স্কুটারের কারখানা তৈরি করেন ভবেশ। সেখানে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ভিত্তিক রোবট প্রযুক্তিকে কাজে লাগান তিনি। ফলে একসময়ে মাত্র দু’সেকেন্ডে একটি ই-স্কুটার তৈরি করে সারা দেশে হইচই ফেলে দেয় সংশ্লিষ্ট স্টার্ট আপ সংস্থা।
২০২২ সালে শেয়ার বাজারে মেগা এন্ট্রি নেয় ওলা ইলেকট্রিক। ওই সময় দেশের অন্যতম বড় ‘ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং’ বা আইপিও এনেছিল এই সংস্থা। ফলে তালিকাভুক্তির সময় ওলা ইলেকট্রিকের স্টকের দর ওঠে ৭৬ টাকায়। শুধু তা-ই নয়, একসময়ে শেয়ারের দাম বাড়তে বাড়তে ১৫৭ টাকায় পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে ই-বাইক ও ই-স্কুটার নির্মাণকারী সংস্থাটির স্টক খাদে পড়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। কারণ বর্তমানে দাম ৩১-৩২ টাকার মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে।
দেশের তাবড় ব্রোকারেজ ফার্মগুলির তরফে জানা গিয়েছে, চলতি বছরে বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের (বিএসই) সবচেয়ে খারাপ পারফর্ম করা স্টকগুলির মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ওলা ইলেকট্রিক। এর ঠিক আগে থাকা সংস্থাটির নাম ফার্স্টক্রাই। চলতি আর্থিক বছরে (২০২৫-’২৬) বিএসইতে ওলার শেয়ারের দাম এখনও পর্যন্ত পড়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ। গত এক মাসে সংশ্লিষ্ট স্টকে ২৬ শতাংশ, তিন মাসে ৫০ শতাংশ, ছ’মাসে ৩২ শতাংশ এবং এক বছরে ৭০ শতাংশের পতন দেখতে পাওয়া গিয়েছে।
ওলা ইলেকট্রিকের শেয়ার মূল্যের পতনের নেপথ্যে একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে ই-স্কুটার তৈরি করে বাজারে হইচই ফেলে দিলেও ক্রেতাদের মন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ভবেশের সংস্থা। কেনার পর ওলার ই-বাইক বা ই-স্কুটার সারানো এবং সার্ভিসিং করার ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যার মুখে পড়তে দেখা গিয়েছে গ্রাহকদের। ফলে অচিরেই অন্যান্য সংস্থার তৈরি বৈদ্যুতিন বাইক বা স্কুটার কেনার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন তাঁরা।
দ্বিতীয়ত, গত কয়েক মাসে একাধিক বার ব্যাটারি গরম হয়ে যাওয়া এবং তার থেকে ওলা ইলেকট্রিকের বাইক বা স্কুটারে আগুন ধরে যাওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসে। ফলে বেঙ্গালুরুর সংস্থাটির তৈরি বৈদ্যুতিন দু’চাকার যানগুলি ব্যবহার করা কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। এতে এক দিকে যেমন কমেছে ওলার ই-বাইক বা ই-স্কুটারের বিক্রি, অন্য দিকে তেমন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে সংস্থার লোকসানের অঙ্ক।
এ বছর কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের থেকে তৃতীয় বার নোটিস পায় ওলা ইলেকট্রিক। সংস্থার বিরুদ্ধে উঠেছে একাধিক কারচুপির অভিযোগ। গত ১০ ডিসেম্বর ভবেশের সংস্থার রেজিস্ট্রেশন স্থগিত করে বিজেপি-শাসিত গোয়ার সরকার। ই-স্কুটারের সার্ভিসিং এবং মেরামতিতে অস্বাভাবিক দেরির কারণে এই কড়া পদক্ষেপ বলে জানিয়েছিল প্রমোদ সবন্তের প্রশাসন। পর পর এ ভাবে ধাক্কা খাওয়ায় যথেষ্টই মার খেয়েছে ভবেশের সংস্থার ব্যবসা।
ভারতের বৈদ্যুতিন গাড়ির বাজার ধরতে ঝাঁপিয়েছে অন্যান্য সংস্থাও। ওলার দুর্দিনে নিজেদের ব্যবসা বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ একেবারেই হাতছাড়া করেনি তারা। উদাহরণ হিসাবে টিভিএস মোটর্স বা এথার এনার্জির কথা বলা যেতে পারে। এ বছরের নভেম্বরে ই-বাইকের বিক্রি যথাক্রমে ১১ শতাংশ এবং ৫৭ শতাংশ বাড়িয়ে নিয়েছে তারা। ফলে প্রতিযোগিতার বাজারে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে ভবেশের সংস্থা।
গত সেপ্টেম্বরে অন্যতম প্রোমোটার জাপানের সফটব্যাঙ্ক ওলা ইলেকট্রিকের স্টকের পরিমাণ হ্রাস করছে বলে খবর প্রকাশ্যে আসে। শেয়ার বাজার সূত্রে খবর, হাতে থাকা মোট স্টকের ২.১৫ শতাংশ বিক্রি করে দিয়েছে তারা। ফলে বৈদ্যুতিন দু’চাকার যান নির্মাণকারী সংস্থায় জাপানি ব্যাঙ্কটির অংশীদারি ১৭.৮৩ শতাংশ থেকে কমে ১৫.৬৮ শতাংশে চলে আসে। শেয়ার বিক্রির কারণ অবশ্য ওই সময় প্রকাশ করেননি সফটব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এতে আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন লগ্নিকারীরা।
এ বছরের নভেম্বরে পারফরম্যান্সের উপর ভিত্তি করে ওলা ইলেকট্রিকের রেটিং কমিয়ে দেয় মার্কিন আর্থিক সংস্থা মুডিজ়। বেঙ্গালুরুর কোম্পানিটিকে ‘সিএএ১’ শ্রেণিভুক্ত করেছে তারা। যদিও এর বৃদ্ধির সূচককে ঋণাত্মক রেখেছে মুডিজ়। নভেম্বরে চলতি আর্থিক বছরের (২০২৫-’২৬) দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ফল প্রকাশ করে ওলা ইলেকট্রিক। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সময়সীমার মধ্যে সংস্থাটির মোট লোকসানের (নেট লস) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১৮ কোটি টাকা। গত বছর (২০২৪ সালে) একই সময়ে যেটা ছিল ৪১৫ কোটি টাকা।
যদিও গোটা বিষয়টিতে লগ্নিকারীদের চিন্তা করার কিছু নেই বলে বিবৃতি দিয়েছে ওলা ইলেকট্রিক। সংস্থার তরফে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠাতা তথা সিইও তাঁর ব্যক্তিগত অংশীদারির একটি ছোট অংশ এককালীন এবং সীমিত নগদ সংগ্রহের জন্য বিক্রি করেছেন। মূলত, ২৬০ কোটি টাকার প্রোমোটার স্তরের ঋণ পরিশোধ করার জন্য এই পদক্ষেপ করতে হয়েছে তাঁকে।
গত ২৩ ডিসেম্বর ওলা ইলেকট্রিক জানিয়ে দেয় যে প্রোমোটার স্তরের যাবতীয় ঋণ ইতিমধ্যেই পরিশোধ করে ফেলেছে তারা। এর পরই কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয় এর শেয়ারের দাম। ওই দিন প্রায় ১০ শতাংশ উপরের দিকে ওঠে স্টকের সূচক। ফলে প্রতি শেয়ারের দাম ৩১ টাকা থেকে বেড়ে ৩৬.১০ টাকায় চলে আসে।
আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ভবিষ্যতে ফের ওলা ইলেকট্রিকের শেয়ারে দেখা যেতে পারে ‘ষাঁড়ের দৌড়’। তাঁদের যুক্তি, সিইও ভবেশের মধ্যে অতীতের ভুল শুধরে ফেলার একটা ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। ইতিমধ্যেই ডেডিকেটেড হাইপারসার্ভিস সেন্টার চালু করার কথা ঘোষণা করেছেন তিনি। গ্রাহকদের এই সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা দ্রুত মিটিয়ে দিয়ে একটি টাস্ক ফোর্সও তৈরি করেছে বেঙ্গালুরুর সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
কিছু দিন আগে গ্রাহকদের সার্ভিস এবং মেরামতির সমস্যা নিয়ে একটি বিবৃতি দেয় ওলা ইলেকট্রিক। সেখানে বলা হয়, ক্রেতাদের প্রায় ৯১ শতাংশ অভিযোগের দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে বা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর জেরে ফের বাজারে বাড়তে পারে ভারতীয় স্টার্ট আপটির ই-বাইক বা ই-স্কুটারের চাহিদা। তখন এর স্টকের দর ফের ১৫০ ছাড়ায় কি না সেটাই এখন দেখার। তবে শেয়ার বাজারে লগ্নি বাজারগত ঝুঁকিসাপেক্ষ। তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনেই স্টকে বিনিয়োগ করুন। এতে আর্থিক ভাবে লোকসান হলে আনন্দবাজার ডট কম কর্তৃপক্ষ কোনও ভাবেই দায়ী নয়।