প্রতীকী চিত্র।
আমাদের এক দিদা ছিলেন, আমার বাবার কাকিমা। ওঁর স্বামী এবং ছেলে দুজনেই একই দিনে মারা যান। গোটা ঘটনায় উনি এত শক পেয়েছিলেন যে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন কিছুটা। সেই সময় থেকে উনি আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। বোঝেনই তো, তখনকার দিনের এমন কোনও মহিলা যদি থাকতেন, তাঁকে না তাঁর বাপের বাড়ি, না অন্য কেউ রাখতে চাইত। তখন আমার বাবা বলেন যে উনি আমাদের বাড়ির বউ হন, উনি আমাদের বাড়িতেই থাকবেন। ওঁর সমস্ত ভরণপোষণের দায়িত্ব আমার। আমাদের গ্রামের বাড়িতে দিদাকে একটা ঘর দেওয়া হয়েছিল থাকার জন্য। সেই ঘরটা ভীষণ সুন্দর ছিল। ওই ঘরের জানালা দিয়ে বাড়ির সামনে থাকা দুটো পুকুর, ধানক্ষেত, তার পরে থাকা নদী সব দেখা যেত। ভীষণ ভাল লাগত দুর্গের মতো ঘরটা। কিন্তু দিদা যত দিন বেঁচে ছিলেন তত দিন ওই ঘরে ঢোকার উপায় ছিল না। ওঁকে কেউ ঘাঁটাত না। উনি নিজের মতো থাকতেন, ঘুরে বেড়াতেন। এর বাড়ি, তার বাড়িতে খেতেন। এ ভাবেই উনি চলতেন। গ্রামের লোকজন অভিযোগ করত মাঝে মাঝে। বাবা তাঁদের আবার বোঝাতেন।
মাঘ মাসের রটন্তী কালীপুজো হয় আমাদের গ্রামের বাড়িতে, এটাকে কৌলিক পুজোও বলা যায়, মানে কুলের কালী আর কী। খুবই জাগ্রত। পঞ্চমুন্ডির আসন রয়েছে, সেখানেই পূজিত হন দেবী। আর প্রতি বছর বাবা এই সময় গ্রামের বাড়িতে আসতেন, আর থাকতেন সরস্বতী পুজো পর্যন্ত। এক বার সরস্বতী পুজোর সময় হঠাৎ খবর এল আমাদের সেই দিদা মারা গেছেন। আমরা তখন সবাই কলকাতায়। বাবা একা ওখানে। বাবা টেলিগ্রাম করে জানালেন যে দিদা মারা গেছেন। আমরা সবাই গেলাম। বিশাল বড় করে সব কিছুর আয়োজন করা হয়েছিল। বাবা বলেছিলেন খুব বড় করে শ্রাদ্ধ করা হবে।
দুই পিসি, তাঁদের ছেলে মেয়ে, জ্যাঠতুতো দিদিরা, কাকা জ্যাঠারা সবাই এসেছিলেন। গোটা বাড়ি গমগম করছে। এত দিন দিদার ঘরে ঢোকার অনুমতি ছিল না। এ বার সেই ঘরে ঢোকা যাচ্ছে। আর আগেই বলেছি, ঘরটা খুব সুন্দর ছিল। আমরা ওই ঘরে বসেই হইহই করছি। যা হয় বাড়ির সব ছোটরা এক জায়গায় হলে। এমন সময় আমার বড়দা, যিনি আমার থেকে প্রায় ৮-১০ বছরের বড় হবেন উনি এসে বললেন, ‘তোরা এই সময় এই ঘরে হইহই করছিস? জানিস তো ঘরটা এখনও শুদ্ধ করা হয়নি? এটা এখন শুদ্ধ করতে হবে, তারপর…’ আমরা সবাই ওর কথা হেসে উড়িয়ে দিই। ও-ও চলে যায়।
এর পর আমরা সবাই নিচে চলে আসি। খাওয়া দাওয়া চলছে সেই সময় আমার জ্যাঠতুতো দিদি আমায় বলে, ‘কী রে লণ্ঠনটা নিয়ে এলি?’ আমার যত দূর মনে পড়ে, শেষ আমিই ঘর থেকে বেড়িয়েছিলাম, এবং লণ্ঠন নিয়েই বেড়িয়েছিলাম। কিন্তু ও বলে যে, ‘না তুই লণ্ঠন নিয়ে আসিসনি।’ আমি বলি ‘না, আমি নিয়ে এসেছি।’ কিন্তু জোর দিয়ে বলতে পারছিলাম না যেহেতু আড্ডা, গল্প মশগুল হয়ে ছিলাম। যাই হোক, আমি-ই যাই লণ্ঠন আনতে। শিকল খুলে ঘরে ঢুকি। ভিতরে পুরো অন্ধকার। দিদিও সঙ্গে ছিল, ও বলে ওই তো নিভে গিয়েছে। অন্ধকারে বুঝতে পারছিলাম না। আরও ভিতরে ঢুকে দেখি ডান দিকে দিদা দাঁড়িয়ে আছে সাদা শাড়ি পরে। আর দেখেই যেন ৪৪০ ভোল্টের ঝটকা খেলাম। ‘বাবা গো’ বলে চিৎকার করে বেরিয়ে আসি। পাশের ঘরে সেজ কাকা ছিল, তাঁর কাছে গিয়ে বলতে থাকি ‘দিদা দিদা....’ ভয়ে মরছিলাম একদম। তখন দেখি সবাই হাসছে আমায় দেখে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ দেখি বড়দা বেরিয়ে আসছে। ও-ই দিদার মতো শাড়ি পরে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল আমায় ভয় দেখাবে বলে। এটা কিন্তু পুরোটাই পরিকল্পনা করে করা। আর সেটা সবাই জানত, আমি ছাড়া।
সবাই বলেছিল ভয়টা খরাজকেই দেখানো সম্ভব, বাকিরা যেমন দুর্বল চিত্তের মানুষ, অজ্ঞান হতে পারে, হার্ট অ্যাটাক করে ফেলতে পারে। কিন্তু যতই পরিকল্পনা হোক, বা যাই হোক ওটার পর বুঝেছিলাম ভূত দেখলে কতটা ভয় লাগতে পারে। সত্যিকারের ভূত না দেখলেও অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল। আর সেই ঘটনার পর থেকে আর কোনও ভৌতিক কিছু হলে, বা বললে আর ভয় পাই না। ওটা ওই এক বারই হয়েছিল।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।