সংগৃহীত চিত্র।
'তিন অঙ্ক' বলে একটা ভূতের ছবি করেছিলাম সেখানে সত্যিই ভৌতিক ব্যাপার হয়েছিল। আমাদের বারুইপুর রাজবাড়িতে শ্যুটিং চলছিল। এইচএমআই আলো আপনাআপনি ফেটে যাচ্ছিল। এমন না যে অনেক ক্ষণ চলছে, প্রচণ্ড গরম হয়ে গিয়েছিল তাই ফেটে গিয়েছিল। মাঝরাতে শ্যুট হচ্ছিল, দৃশ্যের একটা নির্দিষ্ট জায়গাতে এসেই আলোটা খালি ডিম (আলোর উজ্জ্বলতা কম) হয়ে যাচ্ছিল। প্রথমে পরিচালক ভেবেছিলেন কেউ হয়তো ইচ্ছে করে এটা করছে। কিন্তু আলোটার আশেপাশে কেউ ছিলই না। কিন্তু বার বার সিনের ওই জায়গাটা এলেই আলোটা কমে যাচ্ছিল। ওইটা একটা অদ্ভুত ঘটনা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ওই সিনেমার সেটেই হুট করে আলো পড়ে আগুন ধরে গিয়েছিল। ওই ভূতের ছবি করতে গিয়ে একাধিক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। ভূত না, কিম্ভূত, অদ্ভুত, জানি না, কিন্তু এরম একাধিক ছোট ছোট সমস্যা হচ্ছিল বার বার। অনেকে সেটে বলছিল ভূতের ছবি তো, তাই ভূতই নাকি করতে দিচ্ছে না।
এ ছাড়া খান্নান রাজবাড়িতে নাকি ভূত রয়েছে। এটা অনেকেই গল্পের ছলে বলে খান্নান রাজবাড়িতে এক জন মহিলার শোয়ার ঘর রয়েছে যেটা সব সময় তালা বন্ধ থাকে। কারও জন্য খোলা হয় না। ওখানেই নাকি ভূত থাকে। এ ছাড়া ওদের একটা নাচ ঘর আছে, সেখান থেকে নাকি রাতে ঘুঙুরের আওয়াজ পাওয়া যায়। ছাদে নাকি ভূত দেখা যায়। আমি নিজে খান্নান রাজবাড়িতে থেকে শ্যুটিং করেছি। একটা সম্পূর্ণ আলাদা দিকে আমি থাকতাম, ইউনিটের বাকিরা আরেক দিকে। প্রথম দিন একটা চমক খেয়েছিলাম। মাঝরাতে উঠেছিলাম ভূত দেখব বলে, হঠাৎ দেখলাম ছাদে কে যেন এক জন দাঁড়িয়ে আছে। পর দিন যখন আবার ওখানে গিয়ে ছাদের দিকে তাকাই দেখি ওটা আসলে একটা পিলার, যাকে রাতে হুট করে দেখে মানুষ বলে ভ্রম হতে পারে। এই সব খুটখাট জিনিস শ্যুটিং করতে গিয়ে দেখেছি, হয়েছে আশেপাশে।
আমার সামনে অর্ক দাশগুপ্তর পরিচালনায় 'পয়লা বৈশাখ' বলে একটা সায়েন্স ফিকশন ছবি আসছে, সময়ের লুপ নিয়ে গল্প। খুবই মনোগ্রাহী গল্পটা। এই ছবির অধিকাংশ শ্যুটিং মাঝরাতে হতো। সেই ছবির শ্যুটিংয়ের সময় একটা জিনিস ঘটেছিল, তবে ভূত বা অতিপ্রাকৃত বলে কিছু মনে হয়নি। তবে শ্যুটিং চলাকালীন আমি নিজেকে দেখতে পেতাম। আমার পাশে আমি নিজেকে দেখতে পেতাম, যে আমাকে দেখছে। স্পষ্ট দেখেছিলাম সেটা। আমি জানি না সেটা আমার আউট অফ বডি অভিজ্ঞতা হচ্ছিল কিনা, ছোটবেলায় আমার এটা হতো। বেশ ঘনঘন হতো। কিন্তু একটা সময়ের পর সেই জিনিস হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। আমি জানি না সেটা আবার শুরু হল কিনা। কিন্তু আগের অভিজ্ঞতার সঙ্গে এটার মিল নেই। আমার শট দিতে দিতে মনে হচ্ছিল আমি পাশে বসে আছি আর নিজেকে দেখছি যে আমি কী করছি।
আরেকটা ঘটনার সাক্ষী থেকেছিলাম। কলেজ ট্রিপের জন্য আমরা ডালহৌসি গিয়েছিলাম। ১৪০ জন ছাত্রছাত্রী বাসে করে অমৃতসর থেকে ডালহৌসি গিয়েছিলাম। প্রচণ্ড হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। আমরা যেখানে ছিলাম সেটা গেস্ট হাউজ টাইপের ছিল। দু’টো পাশাপাশি গেস্ট হাউজে আমরা ছিলাম। যখন আমরা সেখানে ঢুকি তার কিছু ক্ষণের মধ্যে পুরো ডালহৌসি ব্ল্যাকআউট হয়ে যায়। তার সঙ্গে প্রচণ্ড ঠান্ডা। আমরা সবাই জেগে ছিলাম, যা হয় বন্ধুরা এক সঙ্গে থাকলে। খালি সবাইকে বলা ছিল কেউ ঘর থেকে বেরোবে না। নতুন জায়গায় গিয়েছি, তার মধ্যে অন্ধকার, চিনি না জানি না, তাই বাইরে বেরোতে বারণ করা হয়েছিল। প্রতিটি ঘরে আমরা ৪-৫ জন করে ছিলাম। আমাদের পাশের ঘরে যারা ছিল তারা হঠাৎ চিৎকার করতে করতে আমাদের ঘরে চলে আসে। বলে ওরা দু’জন শুয়ে ছিল, আর এক জন নাকি আরেকজনকে শুতে দিচ্ছিল না। চুল টানছিল। যার চুল টানা হচ্ছিল সে বিরক্ত হয়ে উঠে দেখে কে এক জন যেন ওদের মাথার কাছে বসে। সেটা দেখে ওরা চিৎকার করে বেরিয়ে আসে, আমাদের ঘরে এসে ঢোকে। বলে ‘আমরা ওই ঘরে শোবো না’। ওরা আমাদের ঘরেই থেকে যায়। মোট ৬ জন ছিলাম। আস্তে আস্তে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। খালি আমি আর আমার এক বন্ধু জেগে থাকি। আমার বন্ধু সোফায় বসে ছিল, আমি খাটের পায়ের ধারে বসে ছিলাম। গোটা ঘর অন্ধকার, একটা টর্চ আমরা সিলিংয়ের দিক করে জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। ভালই আলো হয়ে ছিল। আমরা কথা বলছিলাম। ও হঠাৎ করেই চুপ করে যায়। আমি ওকে প্রশ্ন করছিলাম, কিন্তু কোনও উত্তর দিচ্ছিল না। তো আমি আবার জিজ্ঞেস করি যে ‘শুনলি?’, তাতেও কোনও উত্তর দেয় না। আমি ইগনোর করে আবার কথাটা বলতে যাই, তখন ভুলভাল সময় উত্তর দিতে শুরু করে, তাও কী ‘হুঁ হুঁ’ করছিল। আমি তাকাই ওর দিকে, আমার খুব স্পষ্ট ভাবে মনে আছে, ওর মুখটা পুরো বদলে গিয়েছিল, কপালটা কেমন যেন ফোলা, নাকটা ফোলা, ব্যাঁকা। মনে হচ্ছিল যেন মাটির দলা কেউ এক জায়গায় ঠুসে রেখেছে। ওটা দেখে প্রচণ্ড চমকে যাই, ভীষণ ভয় পাই। এটা কী দেখলাম মনে হয়। আবার নিজেকে বোঝাই যে আমি ক্লান্ত তাই হয়তো ভুল দেখছি। ওর বসার ধরন বদলে গিয়েছিল। আমি ওই অবস্থাতেও ওর সঙ্গে টানা কথা বলে গিয়েছি, নিজেকে বুঝিয়েছি যে এটা ওই, ও পাল্টায়নি। ও আমার কথা শুনতে পারছে। ভুলভাল প্রশ্ন করছিলাম। যাচাই করতে চাইছিলাম যে ও সেই মানুষটাই কিনা যাকে আমি চিনি। আবার ওর দিকে যখন তাকাই দেখি ওর মুখের গঠন ফের বদলে গিয়েছে। অদ্ভুত মুখটা। ওরম তিন বার ওর মুখ বদলাতে দেখি। তার পর খুব ভয় পেয়ে যাই। আমার পায়ের কাছে একটা বন্ধু শুয়ে ছিল, ওর পা জাপটে ধরে ওকে খামচাতে থাকি যাতে ও উঠে পড়ে নখের খোঁচায়। কিন্তু ও ওঠে না। ওই বন্ধুটাকে বলি যে ‘শোন না আমার খুব ক্লান্ত লাগছে, আমি ঘুমাই হ্যাঁ’। বলে জুবুথুবু হয়ে শুয়ে পড়ি। আর তখনই আমার মাথা ঘাড়ের কাছে সজোরে মারে। আমি লাফিয়ে উঠি। তখন দেখি ওই বন্ধুটা আমায় বলে ‘অ্যাই, কী রে তুই ঠিক আছিস?’ তখন ওর দিকে তাকিয়ে দেখি যে ওর মুখ ঠিক আছে। ও আমায় জানায় যে আমি নাকি মাথা চক্কর খেয়ে পড়ে গেলে যে ভাবে পড়ে যায় আমি ও ভাবে পড়ে গেছি, তাই মেরেছে। তো সে দিন আমি আর কথা বাড়াই না, শুয়ে পড়ি। পর দিন ওকে যখন মনে করাই বা জিজ্ঞেস করি যে কাল রাতে আমাদের কী নিয়ে কথা হচ্ছিল ও বলে যে আমাদের এ সব নিয়ে কখনও কথাই হয়নি।
ভূত আছে কিনা জানি না, তবে কিছু একটা শক্তি তো আছেই। ভূত, ভগবান না কী জানি না, কিন্তু একটা শক্তি তো আছেই। তবে, আমার থেকে বেটার ভূত কেউ হতেই পারে না। (হাসি) ‘ভূতের ভবিষ্যত’-এর ‘কোয়েল’কে ভূত চেনে না, জানে না এটা তো হতেই পারে না! আমি তো ভূত সেজে পারফরমেন্স দিয়ে দিয়েছি। কারও মাথা মটকাতে হয়নি, লোকেরা এমনই এই ভূতটাকে খুব পছন্দ করেছিল। আমার পেশাগত জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত, সময় ছিল সেটা। এই স্মৃতি সব সময় আমার মনে থেকে যাবে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।