চারটে মাত্র দিন, যার জন্য সারা বছর উদগ্রীব হয়ে কাটে বাঙালির। নতুন জামা-কাপড়ের গন্ধ মেখা এক অনাবিল আনন্দের উৎসব। আর তাকে পাখির চোখ করে দুর্গা পুজোর আগে চলে লম্বা কেনাকাটার পর্ব। ইদানীং বছরভর অনলাইন শপিংয়ের ভিড়ে সেই আবেগ যেন কিছুটা ফিকে। তবু মন বলে, স্ক্রিনে দেখে জিনিস কেনার চেয়ে পুজোর আমেজ মাখা বাজারে গিয়ে দরদাম করে, জিনিস হাতে নিয়ে কেনার আনন্দটাই আলাদা। এ যেন উৎসবের আগেই এক টুকরো উদযাপন!
কলকাতার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে আছে এমন অসংখ্য দোকান আর বাজার, যেখানে মধ্যবিত্তের পকেট সামলে পুজো বেশ ভালই জমে ওঠে। চলুন ঘুরে আসা যাক তেমনই কিছু জনপ্রিয় ঠেক থেকে
১. হাতিবাগান, উত্তর কলকাতার নস্টালজিয়া: হাতিবাগানের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফুটপাথ জুড়ে সারি সারি দোকান, আর ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। এটি শুধু একটি বাজার নয়, এটি উত্তর কলকাতার ঐতিহ্যের একটি অংশ। এখানে পোশাক থেকে শুরু করে গয়না, গৃহস্থালীর জিনিসপত্র, এমনকি বাচ্চাদের খেলনাও সস্তায় পাওয়া যায়। পুজোর সময়ে বিভিন্ন ধরনের নতুন পসরা আসে। সেই সবের হাত ধরেই যেন পুজোর আমেজ জাঁকিয়ে বসে শহরে।
২. গড়িয়াহাট, দক্ষিণের সেরা ঠিকানা: দক্ষিণ কলকাতার এই বাজার যেন এক চলমান উৎসব। শাড়ির দোকান থেকে শুরু করে জুতো, গয়না– সব কিছুরই বিশাল সম্ভার একেবারে হাতের নাগালে। এই বাজারের প্রতিটি দোকানেই পুজোর আগে নতুন ডিজাইনের পোশাক আর ফ্যাশন সামগ্রীর এক দারুণ সংগ্রহ নিয়ে সামিল হয় আনন্দযজ্ঞে। ফলে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। শুধু কলকাতার মানুষই নয়, শহরতলির মানুষও এখানে ভিড় করেন কেনাকাটা করতে। দোকানদারদের সাথে জমিয়ে চলে দর কষাকষি। সে-ও কিন্তু এক আবেগ।
৩. নিউ মার্কেট, ঐতিহাসিক বিকিকিনির হাট: কলকাতার প্রাচীনতম এই বাজার যেন নিজেই একট টুকরো জীবন্ত ইতিহাস। পুরনো ও নতুন অংশ মিলিয়ে এই বাজারের দোকানগুলি বিভিন্ন ধরনের পোশাক, জুতো আর অন্যান্য সব জিনিসের এক বিশাল মিলনক্ষেত্র। বাজারের অলিগলিতে লুকিয়ে হরেক রকম দোকান, যেখানে কম দামে ভাল জিনিস পাওয়া যায়। ঠিকমতো দরদাম করতে পারলে তো কথাই নেই! এক সময়ে এটি কলকাতার অভিজাতকুলের কেনাকাটার জায়গা ছিল। কিন্তু এখন সব ধরনের ক্রেতারাই আসেন এখানে।
৪. বড়বাজার, পাইকারি দামে খুশির পসরা: বড়বাজার মানেই পাইকারি বাজার। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, খুচরো ক্রেতারা এখানে যেতে পারবেন না। বরং কম দামে ভাল জিনিস কেনার ক্ষেত্রে এটি কার্যত এক স্বর্গরাজ্য। এখানে জামাকাপড়, শাড়ি, গয়না, এবং পুজোর সাজসজ্জার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই পাইকারি হারে পাওয়া যায়। পুজো শুরুর অনেক আগে থেকেই তাই এখানে কেনাকাটার ভিড় শুরু হয়। কারণ শহরের বেশির ভাগ খুচরা বিক্রেতা এখান থেকেই তাঁদের জিনিসপত্র কেনেন। তাই পকেটের কথা ভেবে কেনাকাটা করতে চাইলে বড়বাজার একটি সেরা ঠিকানা।
৫. বেহালা, স্থানীয় বাজারেই প্রাণের পরশ: দক্ষিণ কলকাতায় থাকেন। হাতিবাগান বা নিউ মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটার সময় হচ্ছে না? তা হলে বেহালা হতে পারে এক অন্যতম বিকল্প। এখানকার একাধিক বাজারে স্থানীয় দোকানগুলোতে দারুণ সব জিনিসপত্র পাওয়া যায়। পকেট বাঁচিয়ে পুজোর কেনাকাটার জন্য এর চেয়ে ভাল আর কী-ই বা হতে পারে!
৬. খিদিরপুর, মধ্যবিত্তের চেনা পথ: খিদিরপুরের বাজারগুলি মূলত মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। এখানে পোশাক, জুতো এবং গৃহস্থালীর নানা জিনিসপত্র তুলনামূলক ভাবে কম দামে পাওয়া যায়। এটি এমন এক জায়গা, যেখানে বাজেট নিয়ে চিন্তা না করেই মনের মতো জিনিস বাছাই করা যায়। পুজোর কেনাকাটার জন্য খিদিরপুর যেন এক বিশ্বস্ত বন্ধু, যা পকেট আর মন, দুয়েরই খেয়াল রাখে।
৭. দক্ষিণাপন, তারুণ্যের হুল্লোড়: দক্ষিণাপনকে বলা চলে তারুণ্যের ঠিকানা। এখানের দোকানগুলিতে কম দামে দারুণ সব পোশাক মেলে। কেতাদুরস্ত পোশাকের সম্ভার দেখা যায়। তরুণ-তরুণীদের জন্য এটি এক আদর্শ কেনাকাটার জায়গা, কারণ কম খরচেই মিলে যায় ট্রেন্ডি সাজ।
৮. ধর্মতলা, ফুটপাথের রঙিন মেলা: ধর্মতলার ফুটপাথে পুজোর সময়ে যেন এক রঙিন মেলা বসে। নানা ধরনের পোশাক, জুতো, ব্যাগ এবং অ্যাক্সেসরিজের দোকান বসে যায়। ভিড়ের মাঝে মনের মতো জিনিস খুঁজে বার করার রোমাঞ্চ এক অন্য রকম স্বাদ এনে দেয়। এখানে দরদাম করে কেনার এক বিশেষ সংস্কৃতি রয়েছে, যা কেনাকাটাকে আরও মজাদার করে তোলে। পকেট বাঁচিয়ে আধুনিক সাজে সেজে উঠতে চান? ধর্মতলা তবে আপনারই জন্য।
৯. শ্যামবাজার, পুরনো কলকাতার গন্ধ: উত্তর কলকাতার এই বাজারটি তার পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। এখানকার শাড়ি এবং পোশাকের সম্ভার নজর কাড়ার মতো। উত্তরের মানুষের পুজোর কেনাকাটায় এটি এক বিশেষ জনপ্রিয় স্থান। এখানে এলে বোঝা যায়, পুরনো কলকাতার সুবাস এখনও শ্যামবাজারের বাতাসে মিশে আছে। ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার এক সুন্দর মেলবন্ধন এখানে দেখা যায়।
১০. হাওড়া বাজার, গঙ্গার ওপার: গঙ্গার ওপারে এই বাজারটি সস্তায় কেনাকাটার এক দারুণ ঠিকানা। যদিও এটি কলকাতার মূল শহর থেকে একটু দূরে। এখানে সব ধরনের জিনিসপত্রই সস্তায় পাওয়া যায়। পুজোর সময়ে এখানেও ক্রেতাদের বেশ ভিড় দেখা যায়। কারণ? পকেট বাঁচিয়ে ভাল জিনিস কেনার অঢেল সুযোগ। পুজোর কেনাকাটা শুধু জিনিস কেনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আসলে বাঙালির আবেগের আর এক নাম। পুজো তো প্রায় এসেই গেল! পছন্দের বাজারগুলোয় ঢুঁ মারবেন নাকি?(এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।)