‘টিনটোরেটোর যীশু’র কথা মনে পড়ে? হীরালাল সোমানির বাড়া ভাতে কেমন ছাই দিয়েছিল তিনটে শ্যামাপোকা! শিউলি-কাশফুল ছাড়া যেমন দুর্গাপুজো অসম্পূর্ণ, তেমনই শ্যামাপোকা ছাড়া শ্যামাপুজো বা কালীপুজোর আবহ তৈরি হয় না।
উৎসবের মরসুমকে যদি একটা ‘ব্যাটিং লাইন-আপ’ হিসাবে ধরা যায়, তা হলে উমা, লক্ষ্মীর বিদায় এবং কালীর আগমনের মাঝে ‘নাইট ওয়াচম্যান’-র মতো শ্যামাপোকার আবির্ভাব ঘটে। হেমন্তের হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্যামাপোকারাও এসে পড়ে, থুড়ি পড়ত।
কোজাগরী লক্ষ্মীর পুজোর পর থেকে সন্ধ্যায় ঘরে আলো জ্বালা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়ত! কারণ, শ্যামাপোকা।
ঝাঁকে ঝাঁকে শ্যামাপোকা বাল্ব, টিউব যে কোনও বাতির চার দিক বৃত্তাকারে ঘিরে থাকত। এই পোকা দীপাবলি তথা আলোর উৎসবের বাহক। আলোর উৎসের প্রতিই এদের ঝোঁক।
আলো নিভে গেলে শ্যামাপোকা খতম। পর দিন সকালবেলা সারা ঘরে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে থাকা শ্যামাপোকাদের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। প্রদীপ বা মোমবাতির আলো হলে এরা ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেরাই আত্মহত্যা করে।
শ্যামাপোকারা কি জানে উহাদের নাম শ্যামাপোকা রেখেছে বাঙালি?
শ্যামাপোকার ইংরেজি নাম গ্রিন লিফহপার। বিজ্ঞানসম্মত নাম— নেফোটেট্টিক্স নিগ্রপিকটাস এবং নেফোটেট্টিক্স ভিরেসেনস।
শ্যামাপোকার প্রধান খাবার হল ধান গাছের রস। হেমন্তে সদ্য শিস আসা ধান গাছ থেকে এরা খাদ্য সংগ্রহ করে এবং ফসলের সর্বনাশ করে।
ফি বছর অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ জাঁকিয়ে শীত পড়ার আগে পর্যন্ত এরা হানা দেয়। আক্রমণের মূল সময় কালীপুজো ও তার আগে পিছে কিছু দিন।
শ্যামাপুজোর সময়ে হানা থেকেই সম্ভবত বাঙালি এদের নাম দিয়েছে শ্যামাপোকা। আরও নাম রয়েছে, সেগুলিও কালীপুজোকে ঘিরে। কোথাও এর নাম কালীপোকা, কোথাও দিওয়ালীপোকা। বিশেষত দক্ষিণ শহরতলির অনেকেই এদের দিওয়ালীপোকা বলেন। আবার গায়ের রঙ শ্যামলা বা সবুজ হওয়ায় এদের নাম শ্যামাপোকা হতে পারে।
শ্যামাপোকার ‘কামব্যাক’ কি ঘটবে? রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে, দোকানে, রেস্তোরাঁয় এমনকী বাড়িতেও হেমন্তের শুরুর সময়টা শ্যামাপোকার উৎপাতে টেকা দায় হয়ে যেত। পোকার অত্যাচার ঠেকাতে আলোকে ঘিরে নিম, দেবদারুর পাতা-সহ ডাল লাগানো, মশারি টাঙানো হতো। চপ, চাউমিনের সঙ্গে বাঙালির পেটে যে কত শ্যামাপোকা গিয়েছে, তার ইয়ত্তা করা সম্ভব নয়!
ইদানিং দূষণ, উষ্ণায়ন, কৃষি জমিতে ব্যাপক হারে কীটনাশক প্রয়োগের কারণে ক্রমশ কমছে শ্যামাপোকার সংখ্যা। খুব আর্দ্র পরিবেশ ছাড়া শ্যামাপোকা বাঁচতে পারে না। জলবায়ু বদলের জেরে এখন সারা বছরই কমবেশি গরম থাকে। কলকাতার আশপাশে এখন আর ধান চাষ হয় না। সে কারণেও শহরে শ্যামাপোকার সংখ্যা কমছে। ঝোপ-জঙ্গল, জলায় শাম্যাপকার জন্ম হয়। শহর থেকে সেসব কবেই উধাও হয়ে গিয়েছে। শ্যামাপোকা থাকবে কী করে?
বিগত কয়েক বছর ধরে শহরে একে বারে কমে গিয়েছে এদের দাপট। তবে শহরতলির কিছু কিছু অঞ্চলে এখনও এদের দেখা যায়। গ্রামে শ্যামাপোকাদের উৎপাত কমেনি।
গত বছর কার্যত উধাও হয়ে গিয়েছিল শ্যামাপোকা। কালীপুজোর কলকাতায় তাদের দেখা মেলেনি। সকলকে চমকে দিয়ে কালীপুজো মেটার পর, জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় ঝাঁকে ঝাঁকে শ্যামাপোকা এসেছিল শহরে। কিশোরকুমার, আরডি বর্মন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পর শ্যামাপোকার ‘কামব্যাক’ মন্দ লাগেনি বাঙালির।
এ বছর এখনও বর্ষা চলছে। ফলে আরও দিন পনের-কুড়ি পর শ্যামাপোকাদের দেখা মিলতে পারে। এখনই নিরাশ হওয়া বা গেল গেল রব তোলা সমীচিন হবে না। আর জীবনানন্দ তো বলেই গিয়েছেন, আশ্বিনের ক্ষেতঝরা কচি-কচি শ্যামাপোকাদের কাছে ডেকে নেবেন।
দীপাবলিতে প্রদীপ জ্বালা, বাজি পোড়ানো রীতির আদত কারণ কিন্তু এই সময়ে জন্মানো নানান ক্ষতিকারক পোকা দমন। কীট, পতঙ্গ কমলেও উৎসবের অঙ্গ হিসাবে রীতিগুলি থেকে যাবে। কিন্তু বাস্তুতন্ত্রের অংশ সকলেই। সহ-নাগরিক না হলেও, সহ-জীব তো বটেই। তাই আর একটু সচেতন হলে আগামী প্রজন্মরাও শ্যামাপোকাদের চোখে দেখতে পারবে। বইয়ে পাতা বা গানের কলিতে শ্যামাপোকা খুঁজতে হবে না। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ)।