Durga Puja 2020

বৌদ্ধতন্ত্রাচারে পুজো পান বলাগড় পাটুলির দ্বিভুজা দুর্গা

অতীতে অর্ধরাত্রি পুজোয় দেবীর উদ্দেশ্যে নরবলি দেওয়া হত। বলির মানুষটি নাকি স্বেচ্ছায় আসতেন।

Advertisement

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২০ ১৪:১০
Share:

একই দেবী, অথচ এই বাংলাতেই তাঁর কত না রূপবৈচিত্র্য।আঞ্চলিকতা ভেদে এই সব প্রাচীন পুজোগুলিতে দেখা যায় ব্যতিক্রমী আচার ও পুজোপদ্ধতি।হুগলি জেলার বলাগড়ের পাটুলিতেযেমন দীর্ঘ কয়েকশো বছর ধরে ব্যতিক্রমী এক দুর্গাপুজো হয়ে আসছে।পাটুলির মঠবাড়ির সেই দ্বিভুজা দুর্গার প্রচলিত নাম মঠের মা।

Advertisement

অতীতে পাটুলি গ্রামে কংসাবতী নামের এক নদী বয়ে যেত।গ্রামে কুয়ো, পুকুর এমনকী বাড়ির ভিত খুঁড়তে গিয়েও নৌকার ভাঙা অংশ, হাল, পাটাতন পাওয়া গিয়েছে। তবে এই গ্রামটির ইতিহাস বলে, বৌদ্ধ যুগে এটি ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির পীঠস্থান।এখানে ছিল একটি প্রাচীন বৌদ্ধমঠ,যার ধ্বংসাবশেষএলাকার প্রবীণরা দেখেছেন।

পাটুলির মঠবাড়ির পুজো নিয়ে শোনা যায় একাধিক কাহিনি।অতীতে পাটলিপুত্র ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান।কোনও কোনও গবেষকের মতে তারই অনুকরণে বৌদ্ধশিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে এই গ্রামে গড়ে উঠেছিল একটি বৌদ্ধমঠ। পরবর্তী কালে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ের ফলে বহু বৌদ্ধতান্ত্রিক দেব-দেবী হিন্দু লৌকিক দেব-দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। খুব সম্ভবত এই মঠবাড়িটি যে বৌদ্ধতান্ত্রিক সম্প্রদায়ের সাধনস্থল ছিল,তাঁদেরআরাধ্য বৌদ্ধ দেবীপরবর্তী কালে দেবী দুর্গার সঙ্গে মিশে যান।তাইদুর্গাপুজোর পদ্ধতির মধ্যে বেশ কিছু তান্ত্রিক প্রভাব রয়ে গিয়েছিল।এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, মঠবাড়ির ঠাকুরদালানে দীর্ঘদিন ধরে একটিপ্রাচীন বুদ্ধমূর্তি রাখাছিল।সংস্কৃতি বিজ্ঞানী বিনয় ঘোষের একটি লেখা থেকে জানা যায়, ‘এই মঠবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বৌদ্ধতান্ত্রিক। আজও মঠবাড়ির পুজোয় দেখা যায় বৌদ্ধতন্ত্রাচারের বিবর্তিত রূপ।’

Advertisement

আরও পড়ুন: সময় যেন থমকে দাঁড়ায় মারহার ঘোষবাড়ির পুজোয়

পাটুলির মঠবাড়ির পুজো নিয়ে শোনা যায় একাধিক কাহিনি।

এই গ্রামেই কয়েকশো বছর ধরেরাঢ়শ্রেণির ব্রাহ্মণ,চট্টোপাধ্যায় পরিবারের বসবাস।কনৌজ থেকে তাঁদের আদি পুরুষ বাংলায় এসেছিলেন। এই বংশের খ্যাতনামা পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার নদিয়ার মহারাজার কাছ থেকে ‘আয়মা পাটুলি’ গ্রামটি লাভ করে এখানে বসবাস শুরু করেন এবং বৌদ্ধতান্ত্রিক প্রভাবযুক্ত এই পুজোর প্রচলন করেন।

জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামো পুজোর মধ্য দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ শুরু হয় এই পুজোয়। আজও বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পীরা মূর্তি নির্মাণ করেন।দুর্গামূর্তিটি অন্যান্য মূর্তির থেকে আলাদা। দেবীর সামনের দু’টি হাত শুধু দেখা যায়। বাকি আটটি হাত, যা আঙুলের মতো, চুলে ঢাকা থাকে। এখানে দেবীর গায়ের রং শিউলি ফুলের বোঁটার মতো।সাবেক বাংলার ডাকের সাজে সজ্জিতপ্রতিমার চোখ বাঁশপাতার মতো। দেবীর ডানদিকে থাকে কার্তিক, বাঁ দিকে গণেশ।আর বাহন পৌরাণিক সিংহ।

জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামো পুজোর মধ্য দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ শুরু হয় এই পুজোয়।

কিছু কিছু বৌদ্ধতান্ত্রিক আচার অনুষ্ঠান আজও রয়ে গিয়েছে মঠবাড়ির দুর্গাপুজোয়।এই পুজোয় সন্ধিপুজো হয় না।জনশ্রুতি বলে, অতীতে অর্ধরাত্রি পুজোয় দেবীর উদ্দেশ্যে নরবলি দেওয়া হত। বলির মানুষটি নাকি স্বেচ্ছায় আসতেন।ইংরেজ আমলে নরবলি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে এই প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। পরিবর্তে চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি নরমূর্তি বলি দেওয়া হয়।আগে পাঁঠা বলি হত।বলির পরে সেই পাঁঠার ছাল ছাড়িয়ে টুকরো টুকরো মাংসের সঙ্গে মাসকলাই ও দূর্বা দিয়ে চৌষট্টি যোগিনীর উদ্দেশে নিবেদন করা হত। এখনপশুবলিও হয় না।তবে চালের গুঁড়োর তৈরি নরমূর্তি বলির পরে একই উপায়ে তা নিবেদন করা হয়।অতীতে তালপাতার পুঁথি দেখে এই পুজো হত। কালের গ্রাসে সেটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তা পুনরুদ্ধার করে নতুন করে লিপিবদ্ধ করা হয়। অষ্টমীর দিন পুরনো প্রথা অনুসারে পুজোর ব্যয়ভার বহন করে স্থানীয় মান্না পরিবার।

আরও পড়ুন: বিজয়িনীর হাসি আর আয়ত চোখের স্নিগ্ধতায় অনন্যা মাতৃমূর্তি

পরিবারের এক সদস্য সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় জানালেন, এক সময় আর্থিক অনটনের মধ্যেও এই পুজো হয়েছিল। সে সময়ে দেবীর স্বপ্নাদেশ অনুসারেযা কিছু সহজলভ্য, তা-ই ভোগে নিবেদন করা হয়েছিল।সেই থেকেই সাদা ভাত, নানা রকম ভাজা, থোড়, মোচা, কচুশাক, চালতার টক ভোগে দেওয়ার রীতি।খিচুড়ি, পোলাও বা অন্য কোনও রাজসিক পদ থাকে না।পরিবার সূত্রে আরও জানা গিয়েছে,এ বার করোনার জন্য কমসংখ্যক লোকজন পুজোর কাজ করবেন। মানা হবে সামাজিক দূরত্ববিধিও।

প্রতি বছর দশমীর বিকেলে দেবীবরণের পরে২০-২২ জন বেয়ারাপ্রতিমাকেকাঁধে নিয়েগঙ্গারউদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।এই সময়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমাকে নামানো হয় এবং স্থানীয় বধূরা আলতা সিঁদুর দেন। এর পরে মান্নাবাড়ির সামনে প্রতিমাকে নামানো হয়। প্রথানুযায়ী মান্নাবাড়ির সদস্যদের উপরই বিসর্জনের দায়িত্বভার থাকে।সাবেক রীতি মেনে আজও নৌকা করে মাঝগঙ্গায় প্রতিমা নিরঞ্জনেরপ্রথাটি বজায় আছে।

ছবি পরিবার সূত্রে পাওয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন