উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বোদাগঞ্জে রয়েছে সুপ্রাচীন ভ্রমরী দেবী মন্দির। এই মন্দিরটি তিস্তা নদীর তীরে পুরাতন শালবাড়ি এলাকায়। এর অন্য নাম ত্রিস্রোতা শক্তিপীঠ। মন্দিরটি বৈকুণ্ঠপুর বনাঞ্চলের সবুজ প্রকৃতির মাঝে এক শান্ত পরিবেশে বিরাজ করছে।
ভ্রমরী দেবীর মন্দির হিন্দুদের পবিত্র ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে অন্যতম। পৌরাণিক মতে, এখানে দেবী সতীর দেহের একটি অংশ পড়েছিল। ভক্তদের বিশ্বাস অনুসারে, এই স্থানে সতীর বাম পা (বা বাম পায়ের পাতা/আঙুল) পড়েছিল। তাই এটি শক্তি সাধনার জন্য এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
এই মন্দিরের দেবী হলেন পার্বতীর এক রুদ্র রূপ, দেবী ভ্রমরী। 'ভ্রমরী' শব্দের অর্থ হল 'মৌমাছির মতো' বা মতান্তরে 'ভ্রমর'। পুরাণে অরুণাসুর নামে এক ভয়ানক অসুরের কাহিনি আছে। অরুণাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং দেবপত্নীদের উপরে অত্যাচার শুরু করেছিলেন।
অসহায় দেবতারা তখন দেবী পরমেশ্বরীর শরণাপন্ন হন। দেবতাদের রক্ষার জন্য দেবী পার্বতী এক বিশাল আকার ধারণ করেন। তাঁর শরীর থেকে কোটি কোটি মৌমাছি, ভীমরুল, বোলতা বেরোতে শুরু করে! এই পতঙ্গ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে অরুণাসুরের মৃত্যু হয়!
ভ্রমরের রূপ ধারণ করে অসুরকে বধ করেছিলেন দেবী! ভ্রমরের এই বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যই দেবী ভ্রমরী নামে পরিচিত হন তিনি। দেবী এখানে শুধু রক্ষাকারী নন, তিনি হলেন 'মৌমাছিকুলের মাতা'। এই কাহিনিই এই মন্দিরের প্রধান লোককথা।
সব শক্তিপীঠেই দেবীর সঙ্গে তাঁর ভৈরব থাকেন। ভ্রমরী দেবী মন্দিরের ভৈরব হলেন ঈশ্বর (অনেকে অম্বর নামেও তাঁর পুজো করেন)। দেবী এখানে কালী রূপে পূজিতা হন। দেবী ভ্রমরী ও ভৈরব ঈশ্বরের যুগল মূর্তি মন্দিরে পূজিত হয়।
স্থানীয় লোককথা অনুসারে, এই অঞ্চলের ইতিহাসের সঙ্গে দেবী চৌধুরানীর যোগ রয়েছে। কিংবদন্তী ডাকাত রানি দেবী চৌধুরানী ও তাঁর গুরু ভবানী পাঠক এই এলাকায় রাজত্ব করতেন। মনে করা হয়, দেবী চৌধুরানী এই মন্দিরে নিয়মিত পুজো দিতে আসতেন। এই লোককথা মন্দিরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছে।
এ ছাড়া, এই মন্দিরটি যেহেতু তিস্তা নদীর তীরে অবস্থিত, তাই এর নাম ত্রিস্রোতা শক্তিপীঠ। এখানে ভক্তরা তিস্তা নদীতে স্নান করে নতুন কাপড় পরে দেবীদর্শনে যান। সারা বছরই এখানে ভক্তদের ভিড় লেগে থাকে।
মন্দিরের নির্মাণশৈলী খুব প্রাচীন না হলেও এর পবিত্রতা শত শত বছরের পুরনো। দেবী এখানে দিবারাত্র ভক্তদের জন্য জাগ্রত থাকেন বলে বিশ্বাস করা হয়। প্রতি মঙ্গল, শনি ও রবিবার এবং অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় দেবীর বিশেষ পুজো হয়। প্রতি বছর শরৎকালে দুর্গাপুজো ও কার্তিক মাসে কালীপুজো সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়।
ভক্তদের বিশ্বাস, ভ্রমরী দেবী তাঁদের সব ইচ্ছা পূরণ করেন। ভক্তরা বিশেষত ধন-সম্পদ, সুস্বাস্থ্য এবং মোক্ষলাভের জন্য এখানে প্রার্থনা করেন। স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে, দেবীর চক্রে (পদ্মাকৃতির) আরোগ্য বা নিরাময়ের ক্ষমতা আছে। ডুয়ার্সের প্রকৃতির মাঝে এই মন্দির এক আধ্যাত্মিক শান্তির ঠিকানা। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ)।