দেবী তারার পবিত্র ধাম: তারাপীঠ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার একটি বিখ্যাত মন্দির নগরী। এটি তান্ত্রিক দেবী তারার মন্দির এবং সংলগ্ন শ্মশানক্ষেত্রের জন্য বিখ্যাত। হিন্দুদের কাছে এটি এক পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। এখানে দেবী উগ্রতারার শিলারূপ প্রতিষ্ঠিত। তিনিই দেবী তারা রূপে পূজিতা হন।
শক্তিপীঠের কিংবদন্তী: পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, তারাপীঠেই দেবী সতীর তৃতীয় নয়নের মণি (তারা) পড়েছিল। তাই দ্বারকা নদীর পূর্ব পাড়ের এই স্থানটির নাম হয় তারাপীঠ। এটি শক্তি আরাধনার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
সিদ্ধপীঠ তারাপীঠ: তারাপীঠ একটি 'সিদ্ধপীঠ' হিসাবেও পরিচিত। বিশ্বাস করা হয়, এখানে সাধনা করলে জ্ঞান, আনন্দ ও অলৌকিক ক্ষমতা (সিদ্ধি) লাভ হয়। তন্ত্রসাধনার জন্য তারাপীঠ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
ঋষি বশিষ্ঠের সাধনা: স্থানীয় কিংবদন্তী অনুসারে, ব্রহ্মার মানসপুত্র বশিষ্ঠ মুনি এখানে তারাদেবীর পুজো শুরু করেন। প্রথমে তিনি সাধনায় অসফল হন। তখন তিনি তিব্বতে বুদ্ধের (বিষ্ণুর অবতার) কাছে যান। বুদ্ধের উপদেশেই বশিষ্ঠ বামাচারে তারাদেবীর আরাধনা করেন।
তারার মাতৃরূপ দর্শন: বশিষ্ঠের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেবী তারা তাঁর সামনে মাতৃরূপে আবির্ভূতা হন। এই রূপে তিনি শিবকে স্তন্যপান করাচ্ছিলেন। এই দৃশ্য বশিষ্ঠকে সিদ্ধিলাভ করতে সাহায্য করে। মন্দিরে তারার এই মাতৃরূপের প্রতীকী শিলামূর্তি রয়েছে।
বণিক জয়দত্তের গল্প: এক লোককাহিনিতে বণিক জয়দত্তের উল্লেখ আছে। স্বপ্নে দেবী তাঁকে দর্শন দেন এবং স্থানের মাহাত্ম্য জানান। জয়দত্ত সংলগ্ন জঙ্গল পরিষ্কার করে তারার শিলামূর্তি খুঁজে পান। তিনিই তারাপীঠে প্রথম মন্দিরটি নির্মাণ করেন বলে শোনা যায়।
সাধক বামাক্ষ্যাপার জন্ম ও জীবন: তারাপীঠের ইতিহাসের সঙ্গে সাধক বামাক্ষ্যাপার জীবন অবিচ্ছেদ্য। ১২৪৪ বঙ্গাব্দে (১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ) তারাপীঠের কাছেই আটলা গ্রামে তাঁর জন্ম। তিনি 'পাগলা সন্ন্যাসী' বা 'বামাক্ষ্যাপা' নামে পরিচিত হন। দেবী তারাকে তিনি 'ছোট মা' বলে ডাকতেন।
বামাক্ষ্যাপা ও মহাশ্মশান: বামাক্ষ্যাপার জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে মন্দির ও মহাশ্মশানে। তিনি তারাপীঠের মহাশ্মশানের পঞ্চমুণ্ডির আসনে সাধনা করতেন। তারা মায়ের সঙ্গে তিনি সরাসরি কথা বলতেন বলে ভক্তদের বিশ্বাস! তাঁর অলৌকিক কাজ ও ভক্তি তারাপীঠকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে।
বর্তমান মন্দিরের নির্মাণ: তারাপীঠের বর্তমান মন্দিরের ইতিহাস প্রায় ২০০ বছরের পুরনো। মল্লারপুরের জগন্নাথ রায় বাংলা ১২২৫ সনে (১৮১৮ খ্রিঃ) আটচালা এই মন্দিরটি তৈরি করান। তবে, তারাপীঠের পবিত্র তীর্থস্থানের ইতিহাস হাজার-দেড় হাজার বছরেরও বেশি!
পীঠরক্ষক ভৈরব: প্রতিটি শক্তিপীঠের এক জন ভৈরব অর্থাৎ পীঠরক্ষক থাকেন। তারাপীঠের ভৈরব হলেন শিব, যিনি এখানে চন্দ্রচূড় রূপে পূজিত হন। তিনি তারা মায়ের বাম পাশে একটি শিবলিঙ্গ রূপে বিরাজমান। তারাপীঠের ভৈরব হিসাবে তাঁরও পুজো করা হয়। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ)।