তাও দান পার্ক - দিনের আলোয় যেন সবুজ মরুদ্যান: ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটির (পূর্বতন সাইগন) কেন্দ্রে অবস্থিত তাও দান পার্ক। ১০ হেক্টরের বেশি জায়গা জুড়ে থাকা এই পার্কটি শহরের 'সবুজ ফুসফুস' হিসাবে পরিচিত। দিনের বেলা এই পার্ক স্থানীয়দের প্রাতর্ভ্রমণ, যোগাভ্যাস, কফি খাওয়া এবং পাখিদের কিচিরমিচির উপভোগের এক আদর্শ স্থান। কিন্তু রাত নামলেই বদলে যায় এর চেনা ছবি!
কেন কুখ্যাত এই পার্ক? বিশ্ব জুড়ে ভূতুড়ে তকমা: তাও দান পার্ক কেবল ভিয়েতনামে নয়, গোটা বিশ্বেই তার ভৌতিক কাহিনির জন্য পরিচিত। আন্তর্জাতিক ভ্রমণ গাইড এবং ম্যাগাজিনগুলি এই পার্ককে বিশ্বের অন্যতম 'ভূতুড়ে স্থান'-এর তালিকায় স্থান দিয়েছে। এই পরিচিতির মূলে আছে এক অতৃপ্ত আত্মার লোককথা।
মূল কাহিনি - প্রেমিকের অতৃপ্ত আত্মা: এই পার্কের ভূতুড়ে কাহিনিটি হল, এক হতভাগ্য যুবকের অতৃপ্ত আত্মার যন্ত্রণাময় গাথা! লোককথা অনুযায়ী, বহু বছর আগে এক সন্ধ্যায় ওই যুবক তাঁর প্রেমিকার সঙ্গে পার্কে সময় কাটাচ্ছিলেন। সেই সময় তাঁরা এক দুষ্কৃতী দলের আক্রমণের শিকার হন। আক্রমণে যুবকটি মারা যান, কিন্তু তাঁর প্রেমিকা পালাতে সক্ষম হন। মতান্তরে - ওই যুবক তাঁর প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, পার্কের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় আততায়ীর হাতে নিহত হন। ফলে প্রেমিকার কাছে আর পৌঁছতে পারেননি তিনি!
রাত হলেই শুরু হয় আত্মার সন্ধান: বিশ্বাস করা হয়, আততায়ীর হাতে খুন হওয়া সেই যুবক আজও তাঁর প্রেমিকাকে খুঁজে বেড়ান! তাই, প্রতি রাতে সূর্য ডোবার পর সেই প্রেমিকের আত্মা পার্কে ঘুরে বেড়ায়! রাতের অন্ধকারে নাকি পার্কে আসা মানুষজন তাঁর পায়ের শব্দ, ফিসফিসানি অথবা গভীর কান্নার আওয়াজ শুনতে পান!
লোককথা বনাম বাস্তব - অন্য একটি বিশ্বাস: যদিও পার্ক কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় কিছু লোকজন এই রোমান্টিক ভৌতিক গল্পটি অস্বীকার করে। তাদের মতে, ভিন্ন একটি কাহিনি চালু আছে। ১৯৮০-এর দশকে এক যুবক পার্কে তাঁর মোটরসাইকেল বিক্রি করার সময় খুন হন। সেই ঘটনার জেরেই এই ভূতুড়ে রটনা তৈরি হয়, যার নাকি কোনও বাস্তবতা নেই! তবে, যে কাহিনিই সত্যি হোক, রাতের বেলা পার্কের পরিবেশ যে পাল্টে যায়, তা অনেকেই স্বীকার করেন।
রাতের বেলা পার্ক কেন নিষিদ্ধ: তাও দান পার্ক সাধারণত রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে কেবল ভূতের ভয় নয়, অন্যান্য কারণেও স্থানীয়রা সূর্য ডোবার পর এই পার্ক এড়িয়ে চলেন। এর প্রধান কারণ হল - রাতের বেলা অপরাধমূলক কার্যকলাপ (যেমন ছিনতাই বা চুরি) বেড়ে যাওয়া। কর্তৃপক্ষও দর্শনার্থীদের সন্ধ্যার পর এই এলাকায় না থাকার পরামর্শ দেয়।
ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও সমাধি: তাও দান পার্কের ইতিহাসের শুরুটা ফরাসি উপনিবেশিক শাসনকালে। ১৮৬৯ সালে এই পার্কটিকে গভর্নরের প্রাসাদের অংশ থেকে আলাদা করা হয়। পার্কের ভিতর রয়েছে প্রাচীন ল্যাম পরিবারের সমাধি এলাকা। কোনও স্থানের ভিতর সমাধির উপস্থিতি প্রায়শই সেই জায়গায় ভূতুড়ে গল্পের জন্ম দেয়। আর, তাও দান পার্কও তার ব্যতিক্রম নয়।
ভিয়েতনামী লোককথা: 'মা দা' এবং অতৃপ্ত আত্মা: ভিয়েতনামী লোককথায় 'মা' বা অতৃপ্ত আত্মার ধারণা অত্যন্ত প্রবল। এই 'মা' হল সেই সমস্ত আত্মা, যারা কম বয়সে অথবা অস্বাভাবিক ভাবে কিংবা হিংসার শিকার হয়ে মারা যায়। বলা হয়, তারা তাদের অপূর্ণ কাজ বা উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়। তাও দান পার্কের প্রেমিকের আত্মা এই বিশ্বাসকেই আরও জোরালো করে।
রহস্যময় উপস্থিতি - গুজব না সত্যি? অনেক পর্যটক ও স্থানীয় বাসিন্দা রাতের বেলায় পার্কে অস্বাভাবিক ঠান্ডা অনুভব করা, কেউ অনুসরণ করছে এমন অনুভূতি হওয়া, অথবা আলোর ঝিলিক দেখার কথা বলেছেন। এই সব ঘটনাকে অনেকেই কেবল মনের ভুল বা গুজব বলে উড়িয়ে দেন। আবার অনেকে একে অতৃপ্ত আত্মার উপস্থিতি বলে বিশ্বাস করেন। গুজব যাই হোক, রাতের তাও দান পার্কের গা ছমছমে পরিবেশ এখানকার রহস্য আজও জিইয়ে রেখেছে।
দিনের আলোয় ফিরুন, রহস্য জিইয়ে থাকুক: তাও দান পার্ক আজও দিনের বেলা হো চি মিন সিটির অন্যতম সুন্দর এবং শান্ত একটি স্থান। কিন্তু লোককথা, ইতিহাস এবং অজানা আতঙ্কের কারণে রাত নামলে পার্কটি জনশূন্য হয়ে যায়। তাই আপনি যদি রহস্যের সন্ধানে না থাকেন, তবে দিনের আলোতেই ঘুরে আসুন ভিয়েতনামের এই ঐতিহাসিক পার্ক। রাতের রহস্য রাতের অন্ধকারেই লুকিয়ে থাকুক! (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।)