পুণে শহরের অলিগলিতে লুকিয়ে আছে এই আশ্চর্য গণেশের গল্প। সাধারণত গণেশের বাহন বললে ইঁদুরের কথাই মনে পড়ে। কিন্তু এই মন্দিরে গণেশের বাহন ইঁদুরের বদলে ময়ূর।
শুধু তাই নয়, এই গণেশের আছে তিনটে শুঁড় আর ছ’টা হাত! এই ত্রিশুণ্ড ময়ূরেশ্বর গণপতির নামের পেছনেও আছে এক দারুণ কাহিনি।
১। পুরাণে গণেশের বেশ কিছু অবতার উল্লেখ আছে। তার মধ্যে এক বিশেষ রূপ হল ময়ূরেশ্বর। দেবতাদের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে তিনি এই অবতারে আবির্ভূত হয়েছিলেন অসুর সিন্ধুকে বধ করার জন্য।
২। সিন্ধু ছিল গান্ডকী নগরের রাজা চক্রপাণির সন্তান। জন্ম থেকেই দুষ্ট স্বভাবের, শিশু বয়সেই সে মানুষ ও হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করতেন। বড় হওয়ার পর লক্ষ্য স্থির করলেন, তিন লোক জয় করার।
৩। সূর্যদেবকে তুষ্ট করতে কঠোর তপস্যায় লিপ্ত হন সিন্ধু। খুশি হয়ে সূর্যদেব তাঁকে দিলেন এক অমৃতের কলস। শর্ত ছিল, কলসটি যতক্ষণ গলায় থাকবে ততক্ষণ মৃত্যু হবে না।
৪। সূর্যদেবের বরপুত্র সিন্ধু দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গ দখল করে নেন। পুজো-যজ্ঞ বন্ধ করিয়ে ঘোষণা করেন দেবতাদের নয়, তাঁরই উপাসনা চলবে।
৫। নিপীড়িত দেবতারা প্রার্থনা করলেন গণেশের কাছে। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, অবতার হয়ে এই রাক্ষসের অবসান ঘটাবেন।
৬। সেই সময়েই তিনি আবির্ভূত হন ময়ূরেশ্বর রূপে। বাহন হল ময়ূর, হাতে শঙ্খ-চক্র-কুঠার। দেবগণ ও রুদ্রগণের মিলিত যুদ্ধ শুরু হল অসুর বাহিনীর বিরুদ্ধে।
৭। সিন্ধুর সেনাপতি উগ্রেক্ষণকে দু’বার পরাজিত করেন গণেশ। অবশেষে চূড়ান্ত যুদ্ধে ময়ূর বাহনে সওয়ার হয়ে তিনি পৌঁছলেন অসুরের রাজ্যে।
৮। আচমকা আঘাত করেন কুঠার দিয়ে। সিন্ধুর গলায় রাখা অমৃতকলস ভেঙে চুরমার হয় তাতে। একই সঙ্গে শেষ হয় অসুর সিন্ধুর জীবনও। দেবতারা ধ্বনিত কণ্ঠে ঘোষিত করলেন, ‘ময়ূরেশ্বরের মহিমা চিরন্তন’।
৯। স্থানীয় মানুষ এঁকে বলেন মোরেশ্বর।
১০। পুনের সোম্বর পেঠের অলি-গলির ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে ত্রিশুণ্ড ময়ূরেশ্বর গণপতি মন্দির। ১৭৫৪ থেকে ১৭৭০ সালের মধ্যে সাধক ভীমজিগিরি গোস্বামীর তত্ত্বাবধানে তৈরি এই মন্দির আজও এক বিস্ময়।
১১। এখানে গণেশের মূর্তি কালো পাথরে খোদাই করা, তিন শুঁড় ও ছয় হাত তাঁর, বসে আছেন এক বিশাল ময়ূরের পিঠে। সাধারণত ইঁদুর বাহনের সঙ্গে গণেশকে সবাই দেখে এসেছে , কিন্তু এখানে যেন ইতিহাস-পুরাণের বিরল এক রূপকথা জীবন্ত রূপ ফুটে উঠেছে।
১২। মন্দিরের স্থাপত্যে রাজস্থান, মালওয়া ও দক্ষিণ ভারতের ছাপ একসঙ্গে মিশে আছে। দেওয়ালে খোদাই করা রয়েছে দেবনাগরী, সংস্কৃত ও ফারসি লিপি। খোদাইয়ে দেখা যায় পৌরাণিক জীবজন্তু, এ যেন ইতিহাস ও শিল্পের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন।
১৩। গর্ভগৃহে প্রবেশের মুখে রয়েছে লক্ষ্মীদেবীর ভাস্কর্য, দু’পাশে দুটি হাতি। সমৃদ্ধি ও সুরক্ষার প্রতীক এই অলঙ্করণ।
১৪। আর এক অদ্ভুত দিক হল ভূগর্ভস্থ কক্ষ। সাধকরা ধ্যান করতেন এখানে। সাধারণত এই সুরুঙ্গপথটি জলপূর্ণ থাকে। কেবল গুরু পূর্ণিমার দিনে এটি পরিষ্কার করে ভক্তদের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
১৫। ভক্তেরা ২১টি দূর্বা আর ২১টি মোদক দিয়ে এখানে গণেশের পুজো করেন। এই মূর্তির প্রতিটি অংশেই যেন এক দারুণ গল্প লুকিয়ে আছে। এটি শুধু একটি মন্দির নয়, বরং ইতিহাস, স্থাপত্য আর আধ্যাত্মিকতার এক সুন্দর মিলনস্থল এটি।
১৬। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, তিন শুঁড় ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের প্রতীক, আবার কেউ বলেন তিন কাল—অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের প্রতীক। অর্থাৎ সৃষ্টির, পালন ও সংহারের নিয়ন্ত্রক একমাত্র তিনি। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।)