অকালবোধন শেষ। কোজাগরীও বিদায় নিয়েছে। এখন চারি দিকে আগমনীর সুর বদলে বাজছে শ্যামা-আহ্বানের শঙ্খধ্বনি। আর ক'টা দিন পরেই দীপান্বিতা, জায়গায় জায়গায় কালীপুজোর আয়োজন।
এই উৎসবের এক নিজস্বতা জড়িয়ে আছে নদিয়ার শান্তিপুর-এর মাটিতে, যা যুগ যুগ ধরে শাক্ত ও বৈষ্ণব ধারার এক পবিত্র মিলনক্ষেত্র। আর সেই মেলবন্ধনের এক উজ্জ্বল প্রতীক হলেন এখানকার মা আগমেশ্বরী।
এ পুজো আজকের নয়, এর গায়ে লেগে আছে প্রায় চারশো বছরেরও বেশি সময়কালের ইতিহাস আর ঐতিহ্য।
শোনা যায়, সেই সুদূর অতীতে শাক্ত ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে এক বিরোধ চলছিল। সেই জটিল সময়েই শান্তিপুরের অদ্বৈতাচার্য্যের প্রপৌত্র মথুরেশ গোস্বামী এক অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিলেন।
তিনি নিজের কন্যার বিয়ে দিলেন তন্ত্রসাধক সার্বভৌম আগমবাগীশ-এর সঙ্গে। এই আগমবাগীশ ছিলেন পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রপৌত্র এবং আগমশাস্ত্রজ্ঞ বলে এই উপাধি লাভ করেন।
বৈবাহিক সম্পর্কেও যখন জটিলতা কাটল না, তখন মথুরেশ গোস্বামী জামাতা-কন্যাকে নিয়ে এলেন শান্তিপুরে। তবে গোস্বামী পরিবার সরাসরি শক্তি উপাসনা করেন না, তাই মথুরেশ তাঁর বসতবাটির থেকে কিছুটা দূরে একটি পঞ্চমুণ্ডির আসন স্থাপন করে দিলেন জামাতার সাধনার জন্য।
এই স্থানটিই বর্তমানে আগমেশ্বরীতলা নামে পরিচিত। সেখানেই কঠোর সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন সার্বভৌম আগমবাগীশ।
লোকমুখে ফেরে, মায়ের নির্দেশে তিনি গঙ্গা থেকে মাটি নিয়ে এসে মূর্তি গড়ে পুজো করেন এবং সেই রাতেই বিসর্জন দেন। সেই প্রাচীন প্রথা আজও নিষ্ঠার সাথে পালিত হয়ে আসছে।
১৬ থেকে ১৮ ফুট উচ্চতার এই নয়ন ভোলানো দেবীর প্রতিমা। দুর্গাপুজোর বিজয়া দশমীর দিন পাটে সিঁদুর দিয়ে পুজোর সূচনা হয়।
আর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন পালিত হয় প্রাচীন ‘পাটখিলান’ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের পরেই শুরু হয় মায়ের মাটির রূপ তৈরি।
কালীপুজোর দিন রাতে হয় চক্ষুদাণ পর্ব। সম্পূর্ণ তন্ত্র মতে মায়ের পুজো হয়। রাত ন’টা নাগাদ বড় গোস্বামী পরিবারের সদস্যরা মাকে নবসাজে সজ্জিত করেন, গহনা পরান।
মৃৎশিল্পী সারা দিন উপবাস থেকে শুদ্ধ বস্ত্রে মায়ের চোখ আঁকেন। এর পর পরিবারের সম্পাদকের সিঁদুর, গন্ধ, আতর দানের পর রাত এগারোটা বা সাড়ে এগারোটা থেকে শুরু হয় পুজো, যা শেষ হতে ভোর হয়ে যায়।
মা আগমেশ্বরীর ভোগে কিন্তু কোনও পশুবলি প্রথা নেই। কেবল একটি আঁখ ও চালকুমড়ো বলিদান হয়। ভোগের থালায় থাকে নানা পদের সমাহার—প্রায় ৩৬ রকমের ব্যঞ্জন, যার মধ্যে আছে তিন ধরনের শাক (লালশাক, কচুরশাক, পালংশাক), শুক্তনি, নানান ডাল, ছানার ডালনা, পোলাও, চাটনি, মিষ্টান্ন সহ সেই সময়ের সব ফল। গোস্বামী বাড়ির দীক্ষিত মহিলারাই ভক্তিভরে এই ভোগ রান্না করেন।
এ পুজোর আরও এক মন-ভোলানো দিক হল পরের দিনের ভোগ বিতরণ। প্রায় ১৪ কুইন্টাল গোবিন্দভোগ চালের পোলাও, আলুরদম আর পায়েস তৈরি হয়। নবদ্বীপের গোস্বামী আশ্রমের প্রতিনিধিরা এসে সেই ভোগ রান্না করেন। হাজার হাজার ভক্ত সেই মহাপ্রসাদ গ্রহণ করেন। এটি যেন শুধু পুজো নয়, এক মহাসমারোহের উৎসবে পরিণত হয়।
পুজো শেষে মায়ের বিসর্জন শোভাযাত্রা যায় শান্তিপুরের মতিগঞ্জের ঘাটে। এক বছর আগে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়ার প্রথা থাকলেও এখন ট্রলারে যান মা। আবার একটি বছরের প্রতীক্ষা শুরু হয় শান্তিপুরের মানুষের।