দেবী কালিকার পুজোয় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কারণবারি বা মদ্য। গৃহস্থের পুজো থেকে স্মশান- সর্বত্রই দেবী পুজোয় কারণ উৎসর্গ করা হয়।
তন্ত্রশাস্ত্র বলে, শক্তিপূজার প্রকরণে মদ্য, মাংস, মৎস, মুদ্রা ও মৈথুন- এই পঞ্চতত্ত্ব আবশ্যক। পঞ্চতত্ত্ব ছাড়া পুজো করলে সেই পুজোয় সাধক, উপাসক বা ভক্ত কাঙ্খিত ফল তো পায়-ই না বরং পদে পদে বিপদে পড়ে। পঞ্চ ম-কারের সাধনফল অসীম। পঞ্চ ম-কারকেই পঞ্চ তত্ত্ব বলে। মদ্য তথা কারণ-ই প্রথম তত্ত্ব।
মহানির্বাণ তন্ত্রে বলা হয়েছে, "গৌড়ী পৈষ্টি তথা মাধবী ত্রিবিধা চোত্তমা সুরা। সৈব নানাবিধা প্রোক্তা তালখর্জুরসম্ভবা।।
গৌড়ী অর্থাৎ গুড় জাত মদ্য, পৈষ্টি অর্থাৎ পিষ্টক জাত মদ্য, মাধবী অর্থাৎ মধুজাত মদ্য- শক্তির উপাসনায় এই তিন মদ্যই সেরা।
আদ্য তত্ত্ব অনুযায়ী- এই সেই মহৌষধি স্বরূপ, যার আশ্রয়ে নিখিল বিশ্বের জীব দুঃখ-ভোগ বিস্মৃত হয়। কিন্তু সাধকের পানের জন্য সাধনা নয়, সাধনার জন্যই পান।
বঙ্গের বুকে মদ-সহকারে তন্ত্রসিদ্ধ পুজোপদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন ঋষি বশিষ্ঠ।
কথিত আছে, এক বার কঠোর তপস্যা শুরু করেন ঋষি বশিষ্ঠ। কিন্তু হাজার হাজার বছর তপস্যা করেও সিদ্ধিলাভ করতে পারছিলেন না। তখন তিনি বিষ্ণুর নির্দেশে রওনা দেন চিনদেশে। দেবী তারার উপাসনাপদ্ধতি আয়ত্ত করার জন্য। সেখানে তিনি দেখেন, পঞ্চ ম কার অর্থাৎ মদ্য-মাংস-মৎস্য-মুদ্রা-মৈথুন সহকারে তন্ত্রমতে দেবী আরাধনা করা হয়। সেই সাধনপদ্ধতিই বশিষ্ঠ নিয়ে আসেন বঙ্গে।
বৈষ্ণবদের পঞ্চগব্য অর্থাৎ দধি-দুগ্ধ-ঘৃত-গোমূত্র-গোময়ের ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে শাক্তদের মদ্য-মাংস-মৎস্য-মুদ্রা-মৈথুন।
'আগমসার' গ্রন্থে প্রথম-ম, 'মদ্য' সাধন বিষয়ে বলা হয়েছে, ''সোমধারা ক্ষরেদ যা তু ব্রহ্মরন্ধ্রাদ বরাননে । পীত্বানন্দময়ীং তাং য স এব মদ্যসাধকঃ ।।''
যার তাৎপর্য, ''হে পার্বতী ! ব্রহ্মরন্ধ্র হইতে যে অমৃতধারা ক্ষরিত হয়, তাহা পান করিলে, লোকে আনন্দময় হয়, ইহারই নাম মদ্যসাধক ।
লোকনাথ বসু তাঁর হিন্দুধর্ম মর্ম গ্রন্থে লিখছেন, পঞ্চ ম কারের প্রথম উপচার মদ কেবল এক পানীয় নয়। তা আসলে ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে ক্ষরিত অমৃতধারা বা সাক্ষাৎ আনন্দ। তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে খুলে যায় মস্তিষ্কের উপরিতল বা ব্রহ্মরন্ধ্র। তখন যে আনন্দধারা প্রবহমান হয়, তাই আসলে মদ্য বা কারণ! ভক্তি যখন ভক্তের অন্তরকে নেশার মতো আছন্ন করে ফেলে তখন ভাবই হয়ে ওঠে কারণসুধা।
কালিকা উপনিষদও কারণের এই অর্থের উপরই জোর দিয়েছে। তার নবম শ্লোকে বলা হয়েছে, পঞ্চমকারের বেদসম্মত আধ্যাত্মিক অর্থ বুঝে যিনি দেবীর অর্চনা করবেন, তিনিই ভক্ত। সিদ্ধমন্ত্রজপকারী সাধকের অনিমাদি অষ্টসিদ্ধি লাভ হয়।
তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ রচিত বৃহৎ তন্ত্রসার অনুসারে এই দেবীর ধ্যানসম্মত মূর্তিটি হল: শ্মশানকালী দেবী কৃষ্ণবর্ণা। তিনি শ্মশানবাসিনী। চক্ষু রক্তপিঙ্গল বর্ণের। আলুলায়িত কেশে দিগম্বররী ক্ষীণাঙ্গী , বাম হাতে মদ ও মাংসে ভরা পানপাত্র, তাঁর দক্ষিণ হাতে সদ্য কাটা নর মুন্ড। দেবী নরমাংসভোগিনী। তিনি ঘোর ভয়ঙ্করী।
বিন্ধ্যবাসিনী দেবী চামুণ্ডার পুজোতেও বলি এবং মদ উৎসর্গের প্রথা প্রচলিত।
গৃহস্থের বাড়ির কালীপুজোতেও কারণবারির চল আছে।
তবে দেবীর পূজার উপাচারে পঞ্চ ম'কারের বিকল্প ব্যবহার করা হয়। মদ্যের বিকল্প কাঁসার পাত্রে ডাবের জল নিবেদন করা হয়। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।)