Kali Puja 2025

কালীপুজোয় কেন অপরিহার্য জবাফুল? নেপথ্যে আছে কোন কারণ?

শিশুকালে ঠাকুমা আমায় নিয়ে সন্ধ্যাজপ, পুজোয় বসতেন। সেখানে নানাবিধ কৌতুহলী প্রশ্নে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতাম। সে রকমই একটি প্রশ্ন, কালীপুজোয় জবাফুলই লাগে কেন?

Advertisement
তমোঘ্ন নস্কর
শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৫ ১০:০৫
Share:
০১ ১৬

শিশুকালে ঠাকুমা আমায় নিয়ে সন্ধ্যাজপ, পুজোয় বসতেন। সেখানে নানাবিধ কৌতুহলী প্রশ্নে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতাম। সে রকমই একটি প্রশ্ন, কালীপুজোয় জবাফুলই লাগে কেন? ঠাকুমা সেকালের মানুষ। পর্দার আড়ালেই জীবন কেটেছে। বেদ, তত্ত্ব, শাস্ত্রের পাঠের সুযোগ হয়নি। তিনি তাঁর বোধ ও উপলব্ধি নরম , সহজবোধ্য একখানা ব্যাখ্যা দিতেন। আর একটি ছিল শোনা কথা, পুরাণ কথা।

০২ ১৬

পৌরাণিক কথা- দেবী সপ্তসতী গ্রন্থ ও পুরাণ থেকে আমরা জানতে পারি যখন দেবী চণ্ডীকার সঙ্গে রক্তবীজের যুদ্ধ চলছিল, তখন ভগবতীর ললাট থেকে দেবী চামুণ্ডা রূপে বহির্ভূত হয়েছিলেন। অতি ভয়ঙ্কর সেই রূপ, ধ্যান মন্ত্র থেকে আমরা যার রূপের বর্ণনা পাই। তিনি করালবদনা, হরিণের চামড়া পরিধান করে আছেন। এক হাতে খর্পর, অপর হাতে বিচিত্র খটাস। তাঁর শরীর শুষ্ক, অতিকায় বিশাল উদর, তিনি নিমস্তা রক্ত নয়না...

Advertisement
০৩ ১৬

যত বারই তিনি রক্তবীজকে হত্যা করছেন, তত বারই রক্তবীজের এক ফোঁটা রক্ত থেকে সৃষ্টি হচ্ছে হাজার রক্তবীজ। দেবী এক হাত দিয়ে রক্তবীজের মুণ্ডচ্ছেদ করছেন আর এক হাত দিয়ে খর্পর সহযোগে রক্ত পান করছেন। তাঁর দৃষ্টি রয়েছে যেন এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়ে পুনরায় হাজার রক্তবীজ সৃষ্টি হতে না পারে। কিন্তু এ ভাবে চলতে চলতে তিনি এতই রক্ত পান করেছিলেন যে, তাঁর সমস্ত শরীর রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছিল এবং উদর হয়েছিল বিশালাকৃতির।

০৪ ১৬

দেবী চামুণ্ডার এই রূপকেই রক্তচামুণ্ডা নামে অভিহিত করা হয়।

০৫ ১৬

অতঃপর দেবী যখন শেষ রক্তবীজকে বধ করছেন, তখন দু’ফোঁটা রক্তবীজের রক্ত মাটিতে পড়ে যায়। দেবী তৎক্ষণাৎ নিজের চরণ দিয়ে চেপে ধরেন যাতে আর নতুন করে রক্তবীজ সৃষ্টি হতে না পারে।

০৬ ১৬

সন্তান যখন মায়ের কাছে অপরাধ করে এবং পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চায়, মা সেই সন্তানকে অবশ্যই ক্ষমা করে দেন। এ ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল। মায়ের চরণতলে থাকা রক্তবিন্দু পরিণত হয়েছিল একটি গাছে, যে গাছটি লাল ফুলে ভরে উঠেছিল। এমত অবস্থায় রক্তবীজ করজোড়ে মায়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যেন সারা জীবন মায়ের চরণতলে থাকতে পারেন। বিশ্বজননী সমস্ত রাগ ভুলে তখন বলেছিলেন যেখানে যেখানে শক্তি পূজা হবে সেখানে জবা ফুলের ব্যবহার হবেই। এ জন্যই দেবীর সব চাইতে প্রিয় ফুল জবা। তার পর থেকেই সমস্ত শক্তি পুজোয় জবা ফুল ব্যবহার হয়ে আসছে।

০৭ ১৬

ফুলের মধ্যে জবা হল সব চাইতে দুর্বল। পদ্ম, গোলাপকে দেখো, কত সুন্দর গন্ধ! অপূর্ব দেখতে... আবার গাঁদাকে দেখো, গাঁদা দীর্ঘদিন টিকে থাকে। কিন্তু জবা বড়ই সাদামাটা। এর না আছে গন্ধ, না আছে স্থায়িত্ব, তার উপরে কটকটে লাল রঙ— সবাই এড়িয়ে চলে।

০৮ ১৬

তাই এক দিন সে মা কালীর কাছে কেঁদে পড়ল। “মা আমাদের কেউ মান দেয় না। কোনও পুজোয় লাগি না।”

০৯ ১৬

প্রত্যুত্তরে দেবী বললেন, “যাদের কেউ নেই, তাদের মা আছে। আজ থেকে আমার পুজোয় তুমিই হবে অপরিহার্য। আর রং কটকটে কে বলেছে! তোমার বর্ণ টকটকে লাল! আমি জগত্তারিণী, ক্রমাগত সৃজন এবং সংগ্রামে আমি রক্তলিপ্ত। লাল সৃজন ও শৌর্যের প্রতীক। তুমি তো আমারই প্রতিনিধিত্ব কর।”

১০ ১৬

সেদিনের মতো শিশুমন সেই তত্ত্ব দ্বারা শান্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন তথ্য এই কথাকে পুনঃ পুনঃ প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।

১১ ১৬

লাল রঙের তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে যে ভাষ্যগুলি পাওয়া যায়– মা কালীর জিহ্বার রং লাল। জিহ্বা কথার অর্থ হল পরম বাক। কণ্ঠ, তালু, মূর্ধা, দন্ত... জিহ্বা স্পর্শ করলেই ধ্বনি তৈরি হয়, উচ্চারণ হয়। সেই লাল জিহ্বার প্রতীক জবা। আদি বাককে নির্দিষ্ট করে।

১২ ১৬

লাল রং ঋতুচক্রের প্রতীক এবং ঋতুচক্র সৃজনের, তাই লাল রং দ্বারা অনন্ত সৃজনকে নির্দিষ্ট করা হয়। এ কারণেই রক্ত জবা অপরিহার্য।

১৩ ১৬

লাল রং শৌর্যের প্রতীক। অসুরদলনী, রক্তবীজবিনাশিনী দেবীর শৌর্যের কথা সর্বজনবিদিত। অতএব তাঁর গলায় যে রক্তজবার অঙ্গ ভূষণ হবে, তাই তো স্বাভাবিক।

১৪ ১৬

লাল রং ভালবাসা, স্নেহের প্রতীক। মায়ের অর্থই হল জগৎব্যপী ভালবাসা। তাঁর ভালবাসা এবং স্নেহ আছে বলেই মৌমাছি পরাগরেণু বহন করে ফুলে এসে বসে। ফুল থেকে ফল হয়। সম্পর্ক তৈরি হয়। এ ভাবেই অনন্ত সৃজনের দ্বারা পৃথিবী গড়িয়ে চলে। এই তত্ত্বের নিরিখে জবাই তো শ্রেষ্ঠ।

১৫ ১৬

আবার লাল রং হল বিপদের প্রতীক অর্থাৎ নারীকে অসম্মান করলে তার ফল ভয়াবহ হতে পারে। এর বহু নিদর্শন আমাদের প্রাচীন মহাকাব্য থেকে বর্তমান সময়ে ছড়িয়ে রয়েছে। সেই লালের বিপদ বার্তা ও সাবধান চেতনা জবা দ্বারা সূচিত করা হয়।

১৬ ১৬

এই কারণেই তো সাধক বলে গেছেন, “মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠনা ফুটে মন....” অর্থাৎ জবার ন্যায় বৃন্তচ্যুত সমর্পণ হয়ে মায়ের কাছে পড়ে রইলে মুক্তি মিলবে। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ)।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement