প্রতীকী চিত্র
পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ হল মহালয়া। ভাদ্র পূর্ণিমার পরদিন থেকে শুরু হয় পিতৃপক্ষ। যার মেয়াদ এক পক্ষকাল। মহালয়ায় অর্থাৎ অমাবস্যায় এসে শেষ হয় পিতৃপক্ষ। পতিতপাবনী গঙ্গায় স্নান সেরে পিতৃপুরুষের উদ্দেশে পিণ্ডদান করে তর্পণ করার রেওয়াজ রয়েছে এই তিথিতে।
‘মহালয়া’ শব্দটির অর্থ মহৎ আলয়। পিতৃলোক অর্থাৎ যেখানে পিতৃপুরুষেরা অবস্থান করেন। তাই সেটি মহৎ আলয়। পিতৃপুরুষেরা মৃত, তাই প্রেতের আলয়ও বটে। শাস্ত্র মতে, এই তিথিতে প্রয়াত আত্মারা প্রিয়জন, উত্তরপুরুষদের দেখতে মর্ত্যে আসেন। তাঁদের তৃপ্ত করতেই জল দানের এই রীতি। মৃত পুর্বপুরুষদের আত্মার তৃপ্তির উদ্দেশ্যে জলদানই হল ‘তর্পণ’।
তর্পণ গোটা বছর করা সম্ভব। কিন্তু মহালয়ায় তর্পণে জলদানের সঙ্গে সঙ্গে তিলও দান করা যায় পিতৃপুরুষের উদ্দেশে, যা পিণ্ডদানের সমতুল্য। পিতৃপুরুষ বলতে কেবল বাবা-মা কিংবা পরিবারের পূর্বপুরুষ নন, সর্বভূতের উদ্দেশে জলদান করা হয়। তৃপ্ত করা হয় ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, সপ্তর্ষি এবং পিতামহ ভীষ্মকে।
মহালয়ার সঙ্গে কি দুর্গাপুজোর কোনও সম্পর্ক রয়েছে?
শাস্ত্রমতে, মহালয়ার সঙ্গে দেবী দুর্গার আরাধনার কোনও সম্পর্ক নেই। কারণ মহালয়ার আগেই দেবী দুর্গার পুজো আরম্ভ হয়ে যায়। কৃষ্ণপক্ষের (যে কৃষ্ণপক্ষের অন্তে অমাবস্যা মহালয়া নামে পরিচিত) অষ্টমীর পরদিন অর্থাৎ জিতাষ্টমীর পরদিন দেবীর বোধন হয়। নাম কৃষ্ণনবম্যাদি কল্পারম্ভ। কৃষ্ণপক্ষের নবমী থেকে পরের নবমী অর্থাৎ শুক্লনবমী পর্যন্ত পুজো চলে। মল্ল রাজাদের হাজার বছরের প্রাচীন দুর্গাপুজো শুরু হয় এই তিথিতে। বীরভূমের মল্লারপুরের দক্ষিণগ্রামের বাবুপাড়ার রায়বাড়িতেও এই তিথিতে দেবীর বোধন হয়।
মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর ভাবনা জুড়ে গেল কী ভাবে?
মহালয়ার দিনটির নবনির্মাণ হয়েছে লোকাচারের দৌলতে। সঙ্গে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিকদের অমর সৃষ্টি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ও খানিকটা দায়ী বটে। দেবী প্রতিমার চোখ আঁকা, মণ্ডপের উদ্দেশে কুমোরপাড়া থেকে প্রতিমার রওনা হওয়া, বাড়ির পুজোয় দেবীর পাটে ওঠা ইত্যাদি লোকাচারে পালনের উদ্দেশে মহালয়া তিথিটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। ভোরবেলা আকাশবাণীর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ তিথিটিকে সাধারণ জনমানসে পৌরাণিক তাৎপর্য দিয়েছে। সর্বোপরি ‘মহালয়ার সাত দিন পরে দুর্গাপুজো’-- এই অমোঘ বাক্যটি বাঙালির মনে মহালয়া আর দুর্গাপুজোকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছে।
মহালয়ার পরদিন প্রতিপদ থেকে শুরু হয় দেবীপক্ষ। আবার মহালয়ার পরদিন হয় প্রতিপদাদি কল্পারম্ভ, প্রতিপদে বোধন। এই কল্পে শুক্ল প্রতিপদ থেকে নবমী অবধি পুজো চলে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে এই তিথিতে পুজো শুরু হয়। দেউলটির চট্টোপাধ্যায় বাড়ি, ইছাপুরের মণ্ডল বাড়িতে প্রতিপদাদি কল্পে বোধন হয়। নবরাত্রি পালন, দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো– সব মিলিয়ে এক পক্ষকালব্যাপী মাতৃ আরাধনা। এক অর্থে তাই মহালয়া দুর্গাপুজোর আগমন বার্তা নিয়ে আসে, কিন্তু পুজোর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।