কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত কালী মন্দির হল বউবাজারের ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি। কথিত আছে, এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাহেব কবিয়াল ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’।
আরও একটি জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’। কালীকে গানও নাকি শোনাতেন অ্যান্টনি। দাবি খানা এমন যেন অ্যান্টনি কবিয়ালের জন্যেই বউবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালীর নাম হয়েছে ফিরিঙ্গি কালী।
তবে এ দাবি যে অসত্য তা লিখে গিয়েছেন ঐতিহাসিক রাধারমণ মিত্র। ‘কলকাতা দর্পণ’ বইতে তিনি লিখেছেন, অ্যান্টনি কবিয়ালের সঙ্গে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির কোনও সম্পর্ক নেই।
ফিরিঙ্গি মূলত ভিনদেশি ইউরোপিয়দের বলা হতো। গোদা বাংলায়, সাহেবদের ফিরিঙ্গি বলে ডাকত দেশীয়রা। কালী কেন ফিরিঙ্গি হলেন?
বউবাজারের ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠা ফলক অনুযায়ী, ৯০৫ বঙ্গাব্দে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অঙ্কের হিসাবে ইংরেজি ১৪৯৮-১৪৯৯ সালে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ তথ্য যদি সত্যি হয় তবে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে অ্যান্টনি কবিয়াল অর্থাৎ হ্যান্সম্যান অ্যান্টনির কোনও সম্পর্ক নেই। অ্যান্টনি কবিয়াল আঠারো শতকের মানুষ।
ভোলা ময়রা আর অ্যান্টনি কবিয়ালের গ্রেট ড্যুয়েল যদি শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে হয়ে থাকে তবে ১৭৫৭-র আগে তা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। কবিয়াল হিসাবে খ্যাতি পেয়ে মন্দির গড়ার অবস্থায় অ্যান্টনি পৌঁছনোর ২০০-২৫০ বছর আগেই ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি ছিল। হয়তো অন্য নামে ছিল।
ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি নামটা এল কী ভাবে? কলকাতা বলতে তখন জলা-জঙ্গলের জনপদ। ভাগিরথীর তীরে জঙ্গলের মধ্যে শ্মশানে পাতা-খড়ের ছাউনিতে ছিল শিব ও শীতলার মন্দির। মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীমন্ত ডোম। ডোম দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে কোনও ব্রাহ্মণ পৌরহিত্য করতে আসতেন না। শ্রীমন্ত নিজেই পুজো করতেন। শিব ও শীতলা মন্দির প্রতিষ্ঠার বেশি কিছু কাল পরে কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এখানে। কালী মূর্তির প্রতিষ্ঠা শ্রীমন্ত নিজেই করেছিলেন কিনা জানা যায় না।
আশপাশের অঞ্চলে বহু ফিরিঙ্গির বসবাস ছিল। সেকালে বসন্তের খুব প্রকোপও ছিল। তখন বসন্ত ছিল মারণ রোগ। বসন্তে ভোগা রোগীদের টোটকা দিতেন শ্রীমন্ত। তাতে রোগীরা ভাল হয়ে উঠতেন।
দেশীয়দের পাশাপাশি ফিরিঙ্গিরাও আসতেন শ্রীমন্তর কাছে। মৃত্যু ভয় তো লালমুখো সাহেব আর ডাল-ভাত খাওয়া বাঙালির আলাদা হয় না!
রোগ সেরে গেলে হিন্দুদের দেখাদেখি ফিরিঙ্গিরাও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এই মন্দিরে পুজো দিতেন। সেই কারণে এই মন্দিরের নাম ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি হতে পারে। এই মন্দিরে আজও শীতলা দেবী আছেন। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, দেবী শীতলা বসন্ত থেকে রক্ষা করেন।
ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির সঙ্গে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র নাম জুড়ে যাওয়ার কৃতিত্ব পুরোপুরি বায়োস্কোপের। উত্তমকুমারের সিনেমা, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘জাতিস্মর’-র কল্যাণে মানুষের মনে জাঁকিয়ে বসেছে যে, ফিরিঙ্গি কবিয়াল আর ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির সম্পর্ক নিবিড়।
তবে একটা প্রচার আগে থেকে ছিলই, জনশ্রুতি হিসাবে ছিল। নয়তো সিনেমায় কেন সে কাহিনি জায়গা পাবে! জনশ্রুতি যে বার বার ইতিহাসের আসন ছিনিয়ে নেয় পৃথিবীতে। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ)।