বাংলার সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাস বাঙালি পাঠকের কাছে এক বিশেষ আবেগের নাম। ১৮৬৬ সালে লেখা সেই উপন্যাসের পটভূমি, পাত্র-পাত্রী—সবই যে শুধু কল্পনায় আঁকা ছিল না, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি মহকুমার দরিয়াপুর গ্রামে গেলে।
এই গ্রামেই রয়েছে সেই ঐতিহাসিক 'কপালকুণ্ডলা মন্দির'। লোকমুখে শোনা যায়, মন্দিরটির বয়স নাকি প্রায় ২৫০ বছরেরও বেশি।
কিন্তু এই মন্দিরের নাম কেন কপালকুণ্ডলা? সাহিত্যপ্রীতি থেকে? নাকি এর নেপথ্যে আছে অন্য কোনও গল্প? আসলে, উপন্যাসের জনপ্রিয়তার আগে এই নামে কোনও মন্দির ছিল না।
এটি আদতে ছিল পড়িয়ারি পরিবারের পূজিতা দেবী ভৈরবীর মন্দির। সাহিত্য আর বাস্তবের অদ্ভুত মিশেল ঘটে এর পরেই।
কথিত , ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে কাঁথির ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন এক ডাকাতির তদন্তে দরিয়াপুরে আসেন, তখনই নাকি এই মন্দিরের ভয়ালদর্শনা কালী বিগ্রহ, গভীর অরণ্য আর সংসারত্যাগী তান্ত্রিকের পরিবেশ দেখে ওই কাহিনির বীজ রোপণ করেছিলেন।
উপন্যাসে নবকুমারকে বলি দেওয়ার জন্য কাপালিক যে বালিয়াড়ির ওপর তন্ত্রসাধনা করতেন, সেই দৃশ্যও নাকি এখানে বসেই কল্পনা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র।
সাধনায় সিদ্ধিলাভের উদ্দেশে কাপালিক নবকুমারকে বলি দেওয়ার জন্য বেঁধে রাখেন। কপালকুণ্ডলা বলি দেওয়ার খড়্গ দিয়েই কেটে দেয় নবকুমারের বাঁধন এবং পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেয়। তন্ত্রসাধনার জন্য কোনও মন্দির ছিল না।
১৮৬৬ সালে ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পরে এই দরিয়াপুরের একটি মন্দির কপালকুণ্ডলা মন্দির নামে পরিচিতি পায়।
বর্তমানে দরিয়াপুরের এই চণ্ডীমন্দির চত্বর বেশ গা-ছমছমে। চুন-সুরকি আর ইটের গাঁথনিতে তৈরি প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো মন্দিরটির চার পাশে ঘন জঙ্গল, গাছপালা।
এই মন্দিরের কাছেই আছে সিদ্ধেশ্বর শিব মন্দির এবং বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতিসৌধ।
এ ছাড়া কাছেই দারুয়া নামে আরও একটি কালী মন্দির আছে, সেটিও কপালকুণ্ডলা কালী মন্দির নামে পরিচিত।
কালীপুজোর ছুটির দিনে সাহিত্য আর ইতিহাসের এই বুননে হারিয়ে যেতে চাইলে কাঁথির দরিয়াপুর গ্রাম-সফর মন্দ হবে না। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।)