প্রদীপের গ্রাম চালতাবেড়িয়া: চালতাবেড়িয়া উত্তর ২৪ পরগনা জেলার একটি বিখ্যাত গ্রাম। এটি দত্তপুকুর থানার অন্তর্গত একটি মৃৎশিল্পের কেন্দ্র। কলকাতা শহর থেকে এই গ্রামের দূরত্ব ৩৮ থেকে ৪০ কিলোমিটারের মতো। গ্রামটি 'প্রদীপ গ্রাম' বা 'দিয়া হাব' নামে পরিচিত!
মৃৎশিল্পের দীর্ঘ ঐতিহ্য: এই গ্রামে কয়েক প্রজন্ম ধরে মৃৎশিল্পের কাজ চলে আসছে। গ্রামের প্রায় ৮০টিরও বেশি পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এখানকার মৃৎশিল্পীদের টেরাকোটা শিল্পের বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। এঁদের তৈরি মাটির জিনিসপত্রের খ্যাতি বিশ্বের দরবারেও পৌঁছে গিয়েছে।
মূল উৎপাদন এবং শ্রমিক সংখ্যা: এই গ্রামের মূল পণ্য হল মাটির প্রদীপ। প্রদীপ ছাড়াও লক্ষ্মী-গণেশ মূর্তি, ঘট, কলসি এবং মাটির ঘর সাজানোর জিনিসপত্র তৈরি হয়। এই শিল্পে প্রায় ছয় হাজার কর্মী নানা ভাবে যুক্ত রয়েছেন। পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকেও বহু মানুষ এখানে কাজ করতে আসেন।
প্রদীপের বৈচিত্র্য ও বিশেষত্ব: চালতাবেড়িয়ার প্রদীপ তার নিখুঁত চেহারা, রং ও ডিজাইনের জন্য জনপ্রিয়। শিল্পীরা বিভিন্ন ধরনের প্রদীপ তৈরি করেন। ময়ূর, পাতার আকৃতির বা একাধিক ধাপের প্রদীপ এখানে মেলে। একটি স্ট্যান্ডে ৩০-৩৫টি প্রদীপ রাখার মতো নতুন ডিজাইনও তৈরি হয়।
দীপাবলির ব্যস্ততা: সারা বছর এখানে মাটির কাজ চললেও দীপাবলির আগে ব্যস্ততা তুঙ্গে থাকে। মে মাসের শেষ দিক থেকেই প্রদীপ তৈরি শুরু করেন শিল্পীরা। কালীপুজো ও দীপাবলির জন্য বিশাল সংখ্যক প্রদীপের চাহিদা মেটানো হয়। প্রত্যেক কারিগর দিনে চার হাজার পর্যন্ত প্রদীপ তৈরি করতে পারেন।
দেশ জুড়ে বাজার: এখানকার তৈরি মাটির সামগ্রী দেশের বিভিন্ন রাজ্যে রফতানি করা হয়। দিল্লি, মুম্বই, হায়দরাবাদ, গুজরাত, অসম এবং রাজস্থানে এখানকার প্রদীপের চাহিদা আছে। কালীপুজো ও দীপাবলির সময়ে এই মাটির প্রদীপ বিদেশের বাজারেও যায়। যশোর রোডের দুই পাশে মৃৎশিল্প সামগ্রীর দোকান দেখতে পাওয়া যায়।
অস্তিত্বের লড়াই: আধুনিকতা ও বিশ্বায়নের কারণে এই কুটির শিল্পও এখন কিছুটা সঙ্কটে। সস্তা চিনা টুনি বাল্ব এবং এলইডি আলোর দাপটে মাটির প্রদীপের চাহিদা কমেছে। পেট্রোল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং কাঁচা মালের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচও বেড়েছে। কিন্তু, শিল্পীরা কম লাভেও ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য লড়াই করছেন।
উদ্ভাবন ও নতুন পণ্য: প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে শিল্পীরা তাঁদের কাজে নতুনত্ব এনেছেন। তাঁরা প্রদীপ ছাড়াও টেরাকোটার মূর্তি এবং আধুনিক ঘর সাজানোর জিনিস তৈরি করছেন। নতুন আকার, আকৃতি এবং সজ্জার ব্যবহার করছেন। মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা চলছে।
কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি: চালতাবেড়িয়া এলাকার মানুষের জন্য এটি স্থায়ী আয়ের উৎস। প্রদীপ তৈরির কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছে এই অঞ্চল। কাজের মান অনুযায়ী এক জন শ্রমিকের দৈনিক উপার্জন ভাল হয়। ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ থাকায় বহু যুবক-যুবতী এই পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি: এই গ্রামে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলে মিলেমিশে কাজ করেন। মৃৎশিল্পের এই কাজে ধর্মীয় ভেদাভেদ নেই। এই শিল্প শুধু অর্থ নয়, গ্রামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তাও বহন করে। এটি বাংলার কুটির শিল্পের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।)