ঢাকার হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন আওয়ামি লিগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, রবিবার ভোর ৪টা ২৪ মিনিটে। অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই অগ্রণীর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
বৃহস্পতিবার অসুস্থবোধ করায় শুক্রবার সকালে তাঁকে ঢাকার ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়ে। শনিবার সন্ধ্যায় তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। রাত ন’টা নাগাদ তাঁকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যক্তিগত সহকারী কামরুল হক জানান, রাত পৌনে চারটে নাগাদ সুরঞ্জিত তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। চিকিৎসকেরা হাসপাতালে ছুটে আসেন। ৪টে ২৪ মিনিটে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মরদেহ রবিবার দুপুর ১২ টায় নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। বিকেল তিনটেয় শ্রদ্ধা জানানো হবে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়। সোমবার তাঁকে দাহ করা হবে তাঁর সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে। ওখানেই আনোয়ারপুর গ্রামে জন্ম সুরঞ্জিতের।
সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বাংলাদেশের আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। বর্ণিল রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী, তুখোর পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিতের রাজনীতির শুরু বামপন্থী সংগঠনে। সাম্যবাদী দর্শনে দীক্ষা নিয়ে ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক জীবন শুরু করা এই নেতা দীর্ঘ ৫৯ বছর দাপটের সঙ্গেই চলেছেন। তবে শেষ জীবনে রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন।
আরও পড়ুন, হাজার পড়ুয়া ধুয়ে দিলেন মায়ের পা, খাইয়ে দিলেন নিজের হাতে, আবেগবিহ্বল নীলফামারি
স্বাধীন দেশের প্রথম জাতীয় সংসদে সদস্য হন। তার পরের চার দশকের বেশির ভাগ সময়েই জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। পালন করেছেন নানান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের সক্রিয় যোদ্ধা ছিলেন সুরঞ্জিত। তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ চলতি নবম জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কমিটির কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
১৯৩৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের আনোয়ারপুর গ্রামে জন্ম সুরঞ্জিতের। তার বাবা চিকিৎসক দেবেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও মা সুমতি বালা সেনগুপ্ত। তিনি দিরাই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স গ্র্যাজুয়েট ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রিও অর্জন করেন। দেশের এই প্রবীণ রাজনীতিক ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।
সত্তরের ঐতিহাসিক প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামি লিগের বিজয়ের সময়ও ন্যাপ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বামপন্থী সুরঞ্জিত ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামি লিগে যোগ দেন।
আরও পড়ুন, ৮০ ভাগ রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণের শিকার, জানাল কফি আনান কমিশন
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একবারই মন্ত্রী হয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তবে ২০১২ সালে রেলপথ মন্ত্রী হওয়ার অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর ছিল না। রেলের উন্নয়নে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিলেও মন্ত্রীর একান্ত সহকারী ওমর ফারুক ৭০ লাখ টাকা-সহ আটক হওয়ার পর ওঠা বিতর্কের পর মন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রীংলার শোক এক বার্তায় জানিয়েছেন, "আমার অনেক বারই সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশের সুযোগ্য নেতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঘনিষ্ঠ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সংস্পর্শে আসার। শেষ বার তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ ভবন চত্বরে আয়োজিত স্বরস্বতী পূজায়, যেখানে তিনি অসুস্থ অবস্থাতেও অংশ নিয়েছিলেন। তিনি একজন শুদ্ধ চিত্তের প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ ছিলেন। তার চলে যাওয়া দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমার হৃদয়ের সমবেদনা তাঁর সহধর্মিনী জয়া সেনগুপ্ত, তার পরিবারের সদস্য, বন্ধু ও স্বজনদের প্রতি।"