পরিচিতি: অর্জুন (২৫)
কী করেন: কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী। থাকেন জেলা শহরে। বাবা সরকারি স্কুলের শিক্ষক। মা গৃহবধু
লক্ষ্য: অবসর জীবনের জন্য লগ্নির পদ্ধতি স্থির করা
চাকরির পরেই লগ্নির জগতে ঢুকে পড়তে হয়তো সকলে পারেন না। অথচ বড় তহবিল তৈরি করতে হলে সেটাই জরুরি। এ জন্য কিছুটা ঝুঁকি নিতেও পিছপা হওয়া উচিত নয়। অর্জুন সেই কথাটা বুঝেছেন। কিন্তু এর মধ্যেও তাঁর সঞ্চয়ের অভিজ্ঞতার অভাব চোখে পড়ছে। যেমন তিনি জানিয়েছেন যে, বড় তহবিল গড়তে মিউচুয়াল ফান্ডে এসআইপি করেছেন। কর বাঁচাতে বেছেছেন ফান্ডেরই ইএলএসএস প্রকল্প। এমনকি তুলনায় কম রিটার্নের কথা ভেবে কর সঞ্চয়ের জন্য পিপিএফেও টাকা রাখতে চান না তিনি। অথচ সেই মানুষই এনডাওমেন্ট পলিসির প্রিমিয়াম গুনছেন বছরে ৩০,০০০ টাকা। যেখানে কর বাঁচানোর সুযোগ মেলে ঠিকই। কিন্তু রিটার্ন অনেকটাই কম। ফলে বড় তহবিল গড়ার পথে পিছিয়ে পড়তে হয় কিছুটা। এই অবস্থায় তাঁকে লগ্নির কিছুটা দিশা দেওয়ারই চেষ্টা করব আমরা।
জীবন বিমায় গলদ
অর্জুন বিয়ে করেননি। তাঁর বাবা চাকরি করেন। তাঁর উপরে কেউ আর্থিক ভাবে নির্ভরশীল নন। যে কারণে এখনই জীবন বিমা করার পরামর্শ দিতাম না। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যেই সেই পথে এগিয়েছেন। ফলে দেখতে হবে কী ভাবে তাঁকে তুলনায় ভাল পথের সন্ধান দেওয়া যায়। এ জন্য আমি বলব টার্ম পলিসির কথা। কারণ, যদি বড় অঙ্কের বিমার সুরক্ষা কবচের কথাই তিনি ভাবেন, তা হলে টার্ম পলিসি তাঁকে সেই সুবিধা দিতে পারে।
বিমা বনাম বিনিয়োগ
এনডাওমেন্ট ও টার্ম পলিসির সবচেয়ে বড় পার্থক্য লুকিয়ে রয়েছে তাদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই। টার্ম পলিসিতে শুধুমাত্র বিমার সুরক্ষাই মেলে। এটি কোনও ভাবেই লগ্নি নয়। ফলে মেয়াদ শেষে বিমার টাকা ফেরত মেলে না। একমাত্র বিমাকারীর মৃত্যু হলে নমিনি বা উত্তরাধিকারী টাকা পান। কোনও কোনও পলিসিতে অবশ্য অ্যাক্সিডেন্ট রাইডার, ক্রিটিক্যাল ইলনেস কভারের সুবিধা পাওয়া যায়। এনডাওমেন্ট পলিসিতে বিমার সুবিধার পাশাপাশি মেয়াদ শেযে টাকা মেলে। কখনও পাওয়া যায় বোনাসও। কিন্তু তা-ও সব মিলিয়ে রিটার্ন মূল্যবৃদ্ধিকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। অর্থাৎ, প্রথমটি যেমন শুধুই জীবন বিমা প্রকল্প, তেমনই দ্বিতীয়টি বিমা ও বিনিয়োগের মিশ্রণ। দু’টি ক্ষেত্রেই কর বাঁচানো যায়।
প্রিমিয়াম
শুধু বিমার সুবিধা মেলে বলে টার্ম পলিসির প্রিমিয়াম তুলনায় অনেকটাই কম। যেমন, ৩০ বছর বয়সে (ধূমপান করেন না) ৩০ বছরের জন্য ১ কোটি টাকার টার্ম পলিসি করলে, প্রিমিয়াম পড়বে বছরে ৮,৫০০ টাকার মতো। অথচ ওই ব্যক্তি একই অঙ্কের এনডাওমেন্ট পলিসিতে করলে দিতে হবে বছরে প্রায় ১ লক্ষ টাকা। অর্থাৎ, হিসেব থেকে বোঝা যাচ্ছে, কম খরচে তুলনায় বেশি অঙ্কের বিমার সুবিধা টার্ম পলিসিতে বেশি।
কোনটা বাছব?
যদি বিমাকে লগ্নি হিসেবে দেখে মেয়াদ শেষে হাতে টাকা পাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য হয়, তা হলে এনডাওমেন্ট প্রকল্প বাছুন। নইলে টার্ম পলিসি করুন।
স্বাস্থ্য বিমা
অর্জুন স্বাস্থ্য বিমার কথা বলেননি। আমার মতে তাঁর অবশ্যই উচিত বয়স কম থাকতেই চিকিৎসা বিমা কেনা। এতে প্রিমিয়াম কম হবে। আবার সাধারণত কম বয়সে ক্লেমও কম হয়। তাই দাবি ছাড়াই বিমার অঙ্ক বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে বাবা-মায়ের জন্যও আলাদা বিমা কিনুন।
আপত্তির কারণ নেই
কর বাঁচানোর জন্য অর্জুন পিপিএফের কথা ভাবতেই রাজি নন। অথচ একটা ভাল আর্থিক পরিকল্পনা তখনই তৈরি হয়, যখন তাতে শেয়ার ও ঋণপত্রে লগ্নির ভারসাম্য বজায় থাকে। শুরুর দিকে যেমন শেয়ারের আধিক্য থাকবে, তেমনই বয়স ও দায়িত্ব বাড়লে ঝুঁকতে হবে ঋণপত্রের দিকে। কিন্তু তা বলে প্রথম থেকেই কোনও একটিকে বাদ দিয়ে যাওয়া ঠিক নয়।
ফলে শুধুমাত্র কর বাঁচানোর প্রকল্প হিসেবে পিপিএফ-কে দেখবেন না। বরং খেয়াল করলে দেখবেন, ইপিএফ এবং পিপিএফ এমন দু’টি প্রকল্প, যেখানে এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত রিটার্ন মেলে। তার উপরে শুধু বছরে লগ্নির উপরেই নয়, করছাড়ের সুবিধা মেলে সুদ ও মোট তহবিলেও। তাই প্রকল্প বাছাইয়ে একবগ্গা মানসিকতা নিয়ে চলা ঠিক নয়। অর্জুনের উচিত পিপিএফ অ্যাকাউন্ট খুলে মাস গেলে হাতে থাকা টাকা সেখানে টাকা রাখা।
ফান্ডে এসআইপি
কম বয়স থেকে মিউচুয়াল ফান্ডে এসআইপি করার কথা বলি আমি। অর্জুন সেই পথই বেছেছেন। তবে তিনি লগ্নি করেন ডিরেক্ট প্ল্যানে। এই ধরনের ফান্ডের সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনই অসুবিধাও রয়েছে। যেমন—
লগ্নিকারীই সব: ডিরেক্ট ফান্ডের ক্ষেত্রে লগ্নিকারীই পুরো সিদ্ধান্ত নেন। পরামর্শদাতা থাকেন না। ফলে কোন ফান্ডে লগ্নি করবেন থেকে শুরু করে সেখানে কত দিন টাকা রাখবেন, কত টাকা ঢালবেন— এই সব কিছুই ঠিক করতে হয় তাঁকে। এই সব বিষয়ে একাই সামলাতে পারবেন মনে করলে তবেই ডিরেক্ট প্ল্যানে লগ্নি করুন।
সুযোগ বুঝে বদল: সাধারণত, পরামর্শদাতা লগ্নিকারীর সঙ্গে বসে আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করেন। সুযোগ মতো তা পাল্টেও দেন তিনি। কিন্তু ডিরেক্ট প্ল্যানে পুরো দায়িত্বই লগ্নিকারীর। ফলে নির্দিষ্ট সময় পর পর ফান্ড খতিয়ে দেখার কথা মনে রাখুন।
খোঁজ-খবর রাখুন: এ ক্ষেত্রে পরামর্শদাতা ও লগ্নিকারী একই ব্যক্তি। ফলে আর্থ-সামাজিক নানা বিষয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি খেয়াল রাখুন। তার সঙ্গেই ফান্ডের জগৎ কী ভাবে কাজ করে, তা-ও জানতে হবে।
শেষে বলব বেতন বাড়লেই এসআইপি বাড়ান। আপৎকালের জন্য লিকুইড ফান্ডে ১ লক্ষ টাকা রাখুন।
(অনুরোধ মেনে নাম পরিবর্তিত)
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)